শহীদ মনিরের ছেলের বাবা ডাক যেন কাঁটা হয়ে বিঁধে স্ত্রীর মনে
আধো আধো বাবা ডাকতে পারলেও নয় মাস বয়সী শিশুটি জানে না এই মধুর ডাক কোনোদিন তার বাবার কানে পৌঁছাবে না। আদরে জড়িয়ে নিতে আসবে না বাবা। মায়ের গর্ভে থাকতেই বুলেটের আঘাতে নিভে গেছে বাবার জীবন প্রদীপ। তাই ছেলের ভাঙা ভাঙা বাব ডাক যেন কাটা হয়ে বিঁধে মা সামিরা ইসলামের মনে।
এ গল্প শিশু মুসআব ইবনে মনিরের। তার বাবা মনিরুজ্জামান মোল্যা মনির (২৫) চব্বিশের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার মিছিলে যোগ দিয়ে গুলিতে শহীদ হন। মনির মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার শাখারপাড় মোল্লাবাড়ি এলাকার মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মোল্যার ছেলে। মৃত্যুর সময় সন্তান সম্ভবা ছিলেন তার স্ত্রী। সন্তানের আগমন নিয়ে নানা স্বপ্ন বুনলেও প্রিয় সন্তানকে দেখে যেতে পারেননি তিনি। সন্তান পৃথিবীতে আসার তিন মাস আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হন মনির।
স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, মনির ঢাকার একটি কলেজে পড়ালেখা করতেন। পাশাপাশি একটি জুতার কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি। পরিবারে মা-বাবা, বোন, স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে মুসআব ইবনে মনির রয়েছে।
আরও পড়ুন:
- ৫ আগস্ট লংমার্চে গিয়ে না ফেরা মুন্নার খোঁজে পাগলপ্রায় মা-বাবা
- শহীদদের ঘরে কান পাতলে আজও শোনা যায় কান্নার রোল
জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট সকালে মনিরুজ্জামান মোল্যা মনির তার এক বন্ধু কাজী আলমকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা যান। সেখানে তারা ছাত্র-জনতার ডাকা গণমিছিলে যোগ দেন। মাদারীপুরে ফেরার পথে পুলিশ সদর দপ্তর সংলগ্ন ফুলবাড়িয়া এলাকার একটি মসজিদে মাগরিবের নামাজ পড়েন। নামাজ শেষে এসে দেখেন পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে গোলাগুলি হচ্ছে। তখন মনির ও তার বন্ধু আলম জীবন বাঁচাতে ওই স্থান থেকে দ্রুত সরে যেতে চেষ্টা করেন। কিন্তু তখন গুলিতে মনির রাস্তায় পড়ে যান। পরে গুরুতর অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মনির।
‘৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণমিছিলে যোগ দিয়েছিলেন মনির। সেই মিছিলে গুলিতে মারা যান তিনি। তখন আমি তখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। আমার আর মনিরের অনেক স্বপ্ন ছিল সন্তানকে নিয়ে। কিন্তু সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই তার বাবা পৃথিবী থেকে চলে গেলো। এখন আমি এই সন্তানকে নিয়েই বেঁচে আছি।’
এদিকে মনিরের পরিবার তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়ায়, খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। পরে তারা ৬ আগস্ট সন্ধ্যায় জানতে পারেন বিজয় মিছিলে মনির গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তার মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে আছে। পরে ওইদিন রাতেই মনিরের মরদেহ নিজ বাড়িতে আনা হয়। পরের দিন ৭ আগস্ট সকালে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
আরও পড়ুন:
- স্বপ্নের রঙিন ঘর-বোনের বিয়ে হলেও নেই কামরুল
- গুলিবিদ্ধ হয়েও আহতকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলেন শহীদ রুবেল
পারিবারিক সূত্রে আরও জানা যায়, মনির সাড়ে তিন বছর আগে মাদারীপুর সদর উপজেলার মধ্যখাগদী এলাকার জলিল সরদারের মেয়ে সামিরা ইসলামকে বিয়ে করেন। পরে মাদারীপুরের নতুন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া থাকতেন মনির। এছাড়াও তার উপার্জনের টাকা দিয়েই চলতো স্ত্রীসহ তার মা, বাবা, এক বোন ও তার সন্তানদের খরচ। এসময় তার স্ত্রী ছিলেন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। মনির মারা যাওয়ার তিন মাস পর ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর জন্ম নেয় তার ছেলে। বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে নাম রাখা হয় মুসআব ইবনে মনির।
মনিরের স্ত্রী সামিরা ইসলামের কাছেই একটু একটু করে বড় হচ্ছে ছেলেটি। সামিরা তার সন্তানকে নিয়ে শহরের বাগেরপাড় এলাকায় তার বোনের বাসায় ভাড়া থাকেন। মনিরের শেষ স্মৃতি আদরের সন্তানকে নিয়ে সারাজীবন থাকতে চান সামিরা।
‘আমার ভাই ছিল আমাদের সংসারের হাল ধরা মানুষ। সে সবার খেয়াল রাখতো। সেই ভাইয়ের একমাত্র সন্তান আজ এতিম হয়ে বেড়ে উঠছে। আমার ভাইয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল তার সন্তানকে নিয়ে। কিন্তু আমার ভাই বাবা ডাক শুনতে পেলো না, সন্তানের মুখটিও দেখতে পেলো না। এই কষ্ট আমাদের সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।’
নিহতের স্ত্রী সামিরা ইসলাম বলেন, ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণমিছিলে যোগ দিয়েছিলেন মনির। সেই মিছিলে গুলিতে মারা যান তিনি। তখন আমি তখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। আমার আর মনিরের অনেক স্বপ্ন ছিল সন্তানকে নিয়ে। কিন্তু সন্তান পৃথিবীতে আসার আগেই তার বাবা পৃথিবী থেকে চলে গেলো। এখন আমি এই সন্তানকে নিয়েই বেঁচে আছি।
নিহতের বোন নুসরাত জাহান ডালিয়া বলেন, আমার ভাই ছিল আমাদের সংসারের হাল ধরা মানুষ। সে সবার খেয়াল রাখতো। সেই ভাইয়ের একমাত্র সন্তান আজ এতিম হয়ে বেড়ে উঠছে। আমার ভাইয়ের অনেক স্বপ্ন ছিল তার সন্তানকে নিয়ে। কিন্তু আমার ভাই বাবা ডাক শুনতে পেলো না, সন্তানের মুখটিও দেখতে পেলো না। এই কষ্ট আমাদের সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
নিহতের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, সন্তানকে ঘিরে আমার ছেলের অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আমার ছেলে বাস্তবে তা দেখতে পেলো না। বাবা ডাক শোনা তো দূরের কথা, ছেলের মুখটাও দেখে যেতে পারেনি।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, শহীদ মনিরের শিশু ছেলের যেকোনো প্রয়োজনে আমরা সাধ্যমতো পাশে থাকার চেষ্টা করবো।
এমএন/এমএস