জুলাইয়ের অর্জন: মানুষ এখন কথা বলার সাহস পায়
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী মোড় ঘুরিয়ে দেয়। দীর্ঘদিনের দলীয় কর্তৃত্ব, নির্বাচনব্যবস্থায় অনিয়ম এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের মাধ্যমে অব্যাহত গুম, খুন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম রাজপথে নেমে আসে। রাজপথে তরুণ-তরুণীদের ঢল, শ্রমজীবী মানুষ, ছাত্র ও পেশাজীবীদের সম্মিলিত প্রতিরোধ ক্রমেই রাজনৈতিক দাবিতে রূপ নেয়।
গণআন্দোলনের চাপে তৎকালীন সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। দেশে গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি ছিল একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, সেনা মোতায়েনের নীতিগত সিদ্ধান্ত এবং ইভিএম বাতিলসহ বেশ কিছু সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করে।
আন্দোলনের অংশ হিসেবে গ্রেফতার হওয়া হাজারো তরুণ-ছাত্রনেতা ও রাজপথের কর্মীদের মুক্তি দেওয়া শুরু হয়। অগণিত রাজনৈতিক মামলার তালিকা পর্যালোচনা করে ভিন্নমতকে দমন করার উদ্দেশ্যে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চালু হয়।
দলীয়করণ দূর করে প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনার দাবি ছিল প্রবল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে টেকনোক্র্যাট নিয়োগ ও মাঠ প্রশাসনে নিরপেক্ষ কর্মকর্তা বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা ও এককেন্দ্রিকতা রোধে সংবিধান সংস্কার প্রসঙ্গ সামনে আসে।
- আরও পড়ুন
- ‘আন্দোলনের নায়কদের সরিয়ে রাজনীতিকদের কাছে চলে গেছে কর্তৃত্ব’
- ৩৬ জুলাই: ‘রুদ্ধশ্বাস’ অধ্যায়ের সমাপ্তি
- কোটা নিয়ে বাড়াবাড়ি, পতন ঘটে শেখ হাসিনার
- যে আশা নিয়ে আন্দোলনে গিয়েছিলাম, পুরোপুরি পূরণ হয়নি
সবচেয়ে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী অর্জন হলো জনতার রাজনৈতিক জাগরণ। তরুণদের নেতৃত্ব, স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং ঐক্যবদ্ধ লড়াই একটি নতুন ধারা তৈরি করেছে—যেখানে দল নয়, জনগণের অধিকারই মুখ্য।
‘মানুষ এখন কথা বলার সাহস পায়’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘জুলাইয়ের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো—মানুষ এখন কথা বলতে পারে, মত প্রকাশ করতে পারে, আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, দেশে এখন একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে—যেটা প্রায় ১৭ বছর ধরে থমকে ছিল।’

‘এখন মানুষ রাজনীতি নিয়ে ভাবে, আলোচনা করে, মত দেয়। রাজনৈতিক মতভেদ নিয়ে খোলামেলা কথা বলে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারের কাজ নিয়েও প্রশ্ন তোলে। এই সংস্কৃতির নতুন করে যাত্রা শুরু হয়েছে, আর এই পরিবর্তনের পেছনে জুলাই আন্দোলনের বড় ভূমিকা আছে।’ বলেন উমামা ফাতেমা।
‘স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চলমান রাখা প্রয়োজন’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর হয়ে গেলো। যে প্রত্যাশা এবং স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা এই অভ্যুত্থানকে সংগঠিত করেছিল, সেগুলো (প্রত্যাশা) এখনও পূরণ হয়নি। এমনকি সেই আকাঙ্ক্ষার বিপরীত দিকে ঘটনাগুলো পরিচালিত করার আশঙ্কা নানাভাবে সৃষ্টি করা হচ্ছে।’

তিনি মনে করেন, ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণের মতামত এবং অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করে দেশে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চলমান রাখা প্রয়োজন।’
- আরও পড়ুন
- নির্দলীয়, সৎ ও দক্ষ লোক পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে
- ৬০০ কোটি টাকার হাসপাতাল এখন জুলাই আহতদের ‘আবাসিক হোটেল’
- এখনো হাসপাতালে জুলাই আহতরা, মানসিক বিপর্যয়ে ৬৭ শতাংশ
- গুলিতে পা হারিয়েও থেমে যাননি জুলাই যোদ্ধা রাইমুল
‘গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকা জরুরি’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সাবের আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও আমাদের দেশে গণতন্ত্রের একটি ধারা ছিল। কিন্তু গত সরকারের সময়ে সেই চর্চা ভেঙে পড়েছিল। জুলাইয়ের আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে—কেউ যতই শক্তিশালী হোক, জনদাবির সামনে মাথা নত করতেই হয়। এটা সব রাজনৈতিক দলের জন্যই একটি শিক্ষা। যদি জনগণকে পাশে না নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করা হয়, সেটা টিকিয়ে রাখা যায় না। মানুষের মাঝে যে আশা ও রাষ্ট্র নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে, সেটা কখনোই পুরোপুরি মুছে ফেলা যায় না। সময় এলেই তারা ঐক্যবদ্ধ হয়।’

সাবের আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘জুলাইয়ের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো—গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকা জরুরি। এখন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের চেষ্টা চলছে। আমরা আশাবাদী, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যদি জনগণের সরকার গঠিত হয়, তাহলে গণতন্ত্রের ভিত্তি আরও মজবুত হবে, আর রাজনৈতিক চর্চায় গুণগত পরিবর্তন আসবে।’
- আরও পড়ুন
- গুলিতে পা হারিয়েও থেমে যাননি জুলাই যোদ্ধা রাইমুল
- দেওয়ালের লেখাগুলো পায়নি পূর্ণতা
- ইউনূস স্যার কয়েক বছর থেকে দেশটা সংস্কার করে দিয়ে যাক
- পা হারিয়ে থেমে গেছে জুলাই আহত শফিকুলের জীবন
‘অর্জন তো এখনও প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘অর্জন তো এখনও প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে। বিচার, নির্বাচনসহ যে আকাঙ্ক্ষাগুলো ছিল তখন, এগুলো সঠিকভাবে পূরণ হলে প্রাপ্তি বা অর্জন হিসেবে ধরা যাবে। এখনও ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। দেখা যাক।’

জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান শুধু একটি সরকারের পতনের আন্দোলন ছিল না, এটি ছিল গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও ভবিষ্যতের পথনকশা নির্মাণের সংগ্রাম। এর অর্জন শুধু তাৎক্ষণিক নয়, বরং একটি সুদূরপ্রসারী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভিত্তি তৈরি করেছে। এখন দেখার বিষয়, এই অঙ্গীকার ও অর্জনগুলো কতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।
এসইউজে/এমএমএআর/এএসএম