অনূর্ধ্ব-১৭ নারী ফুটবল

টাকার অভাবে বিকেএসপি থেকে নাম কাটতে যাচ্ছে প্রতিমা মুন্ডার

আহসানুর রহমান রাজিব
আহসানুর রহমান রাজিব আহসানুর রহমান রাজিব , সাতক্ষীরা সাতক্ষীরা
প্রকাশিত: ০৮:৪১ এএম, ১২ অক্টোবর ২০২৫
অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড় প্রতিমা মুন্ডা

দেশের গর্ব হয়ে ওঠা প্রতিমা মুন্ডার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ এখন দারিদ্র্য। দেশের হয়ে গোল করার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া প্রতিমা মুন্ডা সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খলিশখালী ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের মেয়ে। তিনি অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়। তবে প্রতিমার সেই স্বপ্ন এখন থেমে যাওয়ার পথে। অর্থাভাবে বিকেএসপিতে তার প্রশিক্ষণ প্রায় বন্ধ হতে বসেছে।

২০০৯ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’ খুলনার কয়রায় প্রতিমাদের বসতভিটা কেড়ে নেয়। এরপর নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে তার পরিবার চলে আসে সাতক্ষীরায়। বাবা শ্রীকান্ত মুন্ডা ইটভাটার শ্রমিক, আর মা সুনিতা মুন্ডা অন্যের মৎস্য ঘেরে কাজ করেন। অস্থির জীবনে তিনবেলা খাবারের নিশ্চয়তাও যেখানে নেই, সেখানে মেয়ের পড়াশোনা ও খেলাধুলার খরচ চালিয়ে যাওয়া যেন এক যুদ্ধ।

গাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই প্রতিমার ফুটবলে ঝোঁক দেখা যায়। স্কুল, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে একের পর এক জয় এনে দেয় সে। তখনই তার প্রতিভা নজরে আসে স্থানীয় প্রশিক্ষক আরিফুল হাসান প্রিন্সের। প্রিন্স তাকে নিজের সন্তানের মতো করে গড়ে তোলেন, খেলাধুলা ও শৃঙ্খলার পাশাপাশি জীবনের লড়াই শেখান।

তারপর প্রতিমার আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। জেলা পর্যায়ে সফলতার পর জায়গা পান জাতীয় দলে। ডিফেন্ডার হিসেবে খেলেছেন ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমার ও পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে, দেশের জন্য বয়ে এনেছেন গৌরব। ২০২১ সালে ভর্তি হন বিকেএসপিতে। সেখানে থেকেই ২০২২ সালের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ও ২০২৩ সালের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।

আরও পড়ুন-
রেললাইনের পাশ থেকে বিশ্বকাপের মাঠ কাঁপানো মারুফার গল্প
শিশুদের ‘নোবেল’ পুরস্কারে মনোনয়ন পেলো সাতক্ষীরার সুদীপ্ত
সুখ থাকলেও অর্থাভাবে বিপর্যস্ত খর্বাকৃতির ফরহাদ-আরিফার সংসার

কিন্তু এখন সেই বিকেএসপিতেই তার অবস্থান অনিশ্চিত। প্রতি মাসে ১০০০ টাকা করে বেতন দেওয়ার নিয়ম থাকলেও অভাবের কারণে প্রতিমা পাঁচ বছরের ফি দিতে পারেননি। যদিও ২০২৩ সালে ভিয়েতনামে আন্তর্জাতিক খেলায় অংশ নেওয়ার কারণে এক বছরের খরচ মাফ করা হয়েছিল, তবুও বর্তমানে বিকেএসপি কর্তৃপক্ষের কাছে তার বকেয়া প্রায় ৪৬ হাজার ৮৪০ টাকা।

টাকার অভাবে বিকেএসপি থেকে নাম কাটতে যাচ্ছে প্রতিমা মুন্ডার

বিকেএসপির অধ্যক্ষ লে. কর্নেল মো. ইমরান হাসান গত ২৫ সেপ্টেম্বর এক চিঠিতে (স্মারক নং //২০২৫/৬১২) প্রতিমাকে বকেয়া পরিশোধের নির্দেশ দেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফি পরিশোধ না হলে ‘প্রশিক্ষণার্থী সংক্রান্ত নীতিমালা-২০২১’-এর বিধান অনুযায়ী চূড়ান্ত সতর্কীকরণের পর বহিষ্কারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এই চিঠি হাতে পাওয়ার পর থেকেই প্রতিমা ও তার পরিবার হতাশায় ভেঙে পড়েছে। বাবা-মা জানেন, এই অর্থ তাদের সামর্থ্যের অনেক বাইরে।

প্রতিমার মা সুনিতা মুন্ডা বলেন, মেয়ের খরচ জোগাতে অন্যের ঘেরে কাজ করি। ভগবান যেন মেয়েকে আশীর্বাদ দেন, সে যেন দেশের গর্ব হয়, এই প্রার্থনাই করি।

তিনি জানান, স্থানীয় একটি সংস্থা সহানুভূতির বশে তাদের জন্য ছোট একটি ঘর তৈরি করে দিয়েছে, কিন্তু ঘরে যাওয়ার সঠিক রাস্তা পর্যন্ত নেই। সরকারি কোনো সহায়তাও দীর্ঘদিন পাননি তারা।

প্রতিবেশী বিবেকানন্দ, সুনীল রায়, শেফালী মুন্ডা ও তুলসী মুন্ডা বলেন, প্রতিমা আমাদের গ্রামের গর্ব। যদি সরকার বা সমাজের বিত্তবানরা একটু এগিয়ে আসে, এই মেয়েটি একদিন দেশকে বড় কিছু উপহার দিতে পারবে।

তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপা রানী সরকার বলেন, বর্তমানে সরকারি কোনো বরাদ্দ না থাকলেও সুযোগ এলে প্রতিমার জন্য বসতঘর ও আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা হবে। দারিদ্র্য যেন প্রতিমা মুন্ডার প্রতিভার মৃত্যুঘণ্টা না বাজায় এটাই এখন সবার প্রত্যাশা। কারণ এক প্রতিভাবান কিশোরীর স্বপ্ন যদি কেবল টাকার অভাবে নিভে যায়, তাহলে সেটি শুধু প্রতিমার ক্ষতি নয়, পুরো জাতিরই ক্ষতি। প্রতিমার পাশে দাঁড়ানো মানে দেশের ভবিষ্যৎ নারী ক্রীড়া শক্তিকে বাঁচিয়ে রাখা।

এফএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।