বাজার মনিটরিং কর্মকর্তা প্রতিবেদন দেন ঘরে বসে


প্রকাশিত: ০২:০৮ পিএম, ২১ জুন ২০১৬

বাজারে নিত্যপণ্যের দাম লাগামহীন ঘোড়ার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও কোনো যুক্তি ছাড়াই পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়। একই পণ্যের মূল্য পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে দ্বিগুণ।

বাজারের এই উল্লম্ফন বন্ধের সরকারের একটি বিভাগ রয়েছে। প্রতি জেলায় আছে এই বিভাগের একটি কার্যালয় ও কর্মকর্তা। সিলেটেও এই কার্যালয় এবং কর্মকর্তা আছেন। তার পদের নাম বাজার কর্মকর্তা। কিন্তু তার কর্ম তৎপরতা পরিলক্ষিত হয় না। আর জনসাধারণও জানেননা তাদের কথা।

বাজার কর্মকর্তার কাজ হচ্ছে, কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূলপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাজার ঘুরে প্রতিবেদন তৈরি করে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে তথ্য পাঠানো। তিনি প্রতিবেদন করেন ঠিকই, তবে তা বাজারে গিয়ে নয়, নিজ ঘরে বসেই ! বাজার ঘুরা তার হয় না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাজারে পণ্য বিক্রেতা কৃষক বা পাইকারি ব্যবসায়ীরা তাকে বছরে একবারও বাজারে দেখেন না। এমনকি নিজ অফিসের গলির সামনের ব্যবসায়ীরাও জানেন না, এখানে একজন বাজার কর্মকর্তা থাকেন। পাড়ামহল্লার মানুষও তাকে চেনেন না।

সিলেট বন্দরবাজারের সবজি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই কদিন ধরে কাঁচা মরিচের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষকেরা। উত্তরবঙ্গের কৃষকেরা কাঁচা মরিচ পাইকারি বিক্রি করছেন পাঁচ টাকা কেজি। হবিগঞ্জের কৃষকেরা কাঁচা মরিচ বিক্রি করছেন ১০ টাকা কেজি প্রতি। বর্তমানে সিলেটের বাজারে কাঁচা মরিচ ১৫-২০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

সিলেট সদরের কান্দিগাঁওয়ের কৃষক মজির আলী জাগো নিউজকে জানান, গত শীত থেকে তিনি নিয়মিত সবজি চাষ করছেন। উৎপাদিত সবজি বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে তেমন দাম পাচ্ছেন না। সোবহানিঘাটের ট্রেড সেন্টারে পাইকারি ব্যবসায়ীরা কম দামে কিনে নেন এসব সবজি। কিন্তু যে পেঁপে তিনি বিক্রি করে আসেন ১০ টাকা, পরে সেই পেঁপেই ২৫ টাকা কেজি দরে বাজারে বিক্রি হতে দেখেন। বাজার কৃষকবান্ধব নয়, মধ্য স্বত্বভোগীবান্ধব।

সিলেট নগরীর বাজার ঘুরে জানা গেছে, হবিগঞ্জ থেকে প্রচুর পরিমাণ কৃষিপণ্য বিক্রি করতে নগরীর বাজারে আসেন কৃষকেরা। এছাড়াও উত্তরবঙ্গের ট্রাকবোঝাই কৃষিপণ্য বাজারে আসছে। কিন্তু উত্তরবঙ্গের চাষ করা কৃষিপণ্য পানিতে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় কৃষকেরা কম দামেই বিক্রি করে দিচ্ছেন।

আর সিলেটের বড় পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা কম দামে কৃষিপণ্য এনে বেশি দামে বিক্রি করছেন। কিন্তু নেই কোনো বাজার মনিটরিং। কালেভদ্রে একবার দুবার মনিটরিংয়ে জেলা প্রশাসনের কোনো টিম এলেও তা লোক-দেখানো বলে অভিযোগ আছে। বাস্তবে কৃষকের ন্যায্য দাম পাওয়ার আদৌই কোনো লক্ষণ নেই। এছাড়া কালোবাজারি-মজুতদারদের বিরুদ্ধে কখনো ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয় না। বাজার মনিটরিং কর্মকর্তাদেরও কখনো বাজারে দেখা যায় না।

সরেজমিনে কাজীটুলায় গিয়ে দেখা গেল, মক্তবগলির সামনে কয়েকটি দোকান। একটু দূরেই ৫ নম্বর আপ্তাব মঞ্জিলে জেলা বাজার কর্মকর্তার অফিস। অথচ মক্তবগলির সামনের কয়েকজন দোকানি এই অফিসটা চেনেনই না। অবশেষে একজন দোকানি ৫ নম্বর বাসার কথা বললেন। সেখানে একটি ভাড়া বাসার দোতলার গ্রিলে টানানো ছোট্ট সাইনবোর্ড।

এরই মধ্যে বাসার (কার্যালয়ের) ভেতর থেকে বের হল ফারহান নামের এক শিশু। সে বাজার কর্মকর্তা মুর্শেদ কাদেরের ছেলে। তার মাধ্যমে জানা গেল, দোতলায় মুর্শেদ কাদেরের কার্যালয়। আবার এখানেই তার বাসা। তখন মুর্শেদ কাদের বাইরে ছিলেন।

এমন সময় বাসার বাজার কর্মকর্তার লজিং মাস্টার অফিসে বসে প্রতিদেন তৈরি করছিলেন! মুর্শেদ কাদেরের মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে, তিনি জানান, মোবাইল কোর্টে আছেন।

গত ২২ মে সিলেটে ৫০ জন কৃষককে সচেতন করতে একটি প্রশিক্ষণ হয়। এছাড়া একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সিলেট থেকে প্রাপ্ত কৃষিপণ্যের বাজার দর সেখানে প্রকাশ হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, পরিচিতদের নিয়েই জেলা কর্মকর্তা প্রশিক্ষণটি করেছেন। আর ওয়েবসাইটে তুলে ধরা বাজার রিপোর্টটি তার বাসার লজিং মাস্টারের তৈরি। মুখে মুখে তথ্য নিয়ে তিনি রিপোর্ট তৈরি করে তা জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন দফতরে সরবরাহ করেন। মাস শেষে বেতন নিচ্ছেন।

এ বিষয়ে জেলা বাজার কর্মকর্তা মুর্শেদ কাদের বলেন, অনলাইন ওয়েবপোর্টালের জন্য প্রতিদিন প্রতিবেদন পাঠান তিনি। এছাড়া প্রতি সপ্তাহে একটি প্রতিবেদন অধিদফতরে প্রেরণ করেন। কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেন। বড় বড় ব্যবসায়ীদের বলা হয়েছে, তাদের কৃষিপণ্য ক্রয়ের রশিদ দেখাতে। মাঝে মধ্যে জেলা প্রশাসনের হয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতে যায়।

বাজার কর্মকর্তাকে সংশ্লিষ্টরাই চেনেন না এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে জনবল কম। তাই মনিটরিং দৃশ্যমান হয় না।

প্রসঙ্গত, ১৯৬০ সালে প্রাদেশিক পুনর্গঠন কমিটি কৃষি বিপণন পরিদফতরের উপ-বিভাগ ও জেলা পর্যায়ে লোকবল নিয়োগের অনুমোদন পাওয়ার পর থেকেই প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেট জেলায় কৃষি বিপণন অধিদফতরের কার্যক্রম শুরু হয়।

১৯৬৪ সালের কৃষিজাতপণ্য বাজার নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৮৫ সালের সংশোধিত অধ্যাদেশ) এর মাধ্যমে এ অধিদফতরের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

এআরএ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।