বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে রায়পুরার দাঙ্গা


প্রকাশিত: ০১:১২ পিএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬

নরসিংদীর রায়পুরার চরাঞ্চল নিলক্ষায় দীর্ঘদিন যাবৎ চলছে ধ্বংসযজ্ঞ। ইউপি নির্বাচনোত্তর শুরু হওয়া যুদ্ধ থেমে থেমে চলছেই। উন্মত্ত ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে দেশের বৃহত্তম উপজেলা রায়পুরার নিলক্ষার টেঁটা দস্যুরা। সম্প্রতি তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে প্রায় ৭০টি বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাটের পর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বাড়িগুলো।

ইউপি নির্বাচনের পর থেকে গত কয়েক মাস যাবৎ ধারাবাহিকভাবে ঘটছে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা। সম্প্রতি ঈদের আগে রশিদ নামের এক ব্যক্তিকে মারধরের ঘটনায় বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষুব্ধ সুযোগ সন্ধানী চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীরা একের পর এক ঘটনা ঘটাচ্ছে। এমনকি ঈদের আনন্দও ভাগাভাগি করেতে পারেননি নিলক্ষাবাসী। তারা নিজেদের জানমাল আর সম্পদ রক্ষার জন্যই একস্থান থেকে অন্য স্থানে দৌড়ে বেড়িয়েছেন।

এ সুযোগে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ প্রায় প্রতিটি বাড়ি গিয়ে চাঁদার জন্য হুমকি দিচ্ছে। অন্যথায় বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়া হবে বলে জানিয়ে দেয়। সন্ত্রাসীদের নিষ্ঠুর বর্বরতা থেকে কুকুর পর্যন্ত রক্ষা পায়নি। বেশ কয়েটি কুকুরকেও টেঁটা বিদ্ধ করে গুরুতর জখম করেছে সন্ত্রাসীরা। এলোপাতাড়ি পিটিয়ে আহত করেছে বৃদ্ধ নারীদেরও।

norsingdi

অন্যদিকে পুলিশ বলছে, যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ ঝগড়া ঠেকানো মুশকিল। দুর্গম চরাঞ্চলে হাঁটাপথ ব্যবহার করে দুটি গ্রুপের স্বার্থ নিয়ে প্রতিহিংসার আগুন নির্মূল করা দুরূহ ব্যাপার। বাস্তবতা হচ্ছে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় প্রভাবশালীরা দূর থেকে এ দাঙ্গার বীজ বুনন করছে। ফলে নিলক্ষা থেকেই মোটা অংকের টাকা যাচ্ছে বিভিন্ন ক্যাটাগরির প্রভাবশালী ও দায়িত্ববানদের পকেটে। সেই সঙ্গে রয়েছে নিজেকে প্রভু হিসেবে উপস্থাপন করার কাজটিও।

ব্রিটিশ আমল থেকেই টেঁটা যুদ্ধসহ সংঘর্ষপ্রবণ এলাকা হিসেবে আলোচিত রায়পুরা উপজেলার নিলক্ষা ইউনিয়নটি। মিডিয়ার বদৌলতে টেঁটা যুদ্ধের জন্য নরসিংদী তথা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এ এলাকাটির নাম। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও শিক্ষার আধুনিকতার ছোঁয়ায় দাঙ্গা-ফ্যাসাদ অনেকাংশেই কমে গিয়েছিল এই এলাকার। কিন্তু সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে শুরু হয়েছে দাঙ্গা-হাঙ্গামা।

সরেজমিনে এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নিলক্ষা ইউনিয়নের সরকার বাড়ি থেকে আধা মাইল দূর থেকেই বাতাসে ভেসে আসছে পোড়া গন্ধ। একটু সামনে এগোতেই দেখা গেল পোড়া বাড়ির দৃশ্য। ঘরগুলোর ভিতরে কিছুই নেই; শুধু পোড়া কাঠ, কয়লা আর ছাই। ঘরে আগুন দেওয়ার পূর্বে ইচ্ছেমত লুটপাট চালিয়েছে দস্যুরা।

যতই সামনে যাওয়া যায় ততই বাড়তে থাকে পোড়া বাড়ির দৃশ্য। বীরকান্দি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশের একটি বাড়ির সামনে খড়ের পালা থেকে তখনও ধোয়া বের হচ্ছিল। সদ্য সাবেক হওয়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর হক সরকারের পাকা বাড়িও ভেঙে ফেলেছে হামলাকারীরা। বাড়ির মোটা লোহার গ্রিল ভেঙে ফেলে রাখা হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে ঘরের দেয়াল তারপর দেয়া হয়েছে আগুন।

এমন প্রায় ৭০টি বাড়ি আগুন দিয়ে পুরোপুরি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। মনে হয় এটি যেন কোনো যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকা। আগুনে পোড়া বাড়িঘর দেখতে দূর দূরান্ত থেকে নারীরা দল বেধে আসছে। ভয়ে সাংবাদিকদের কাছে কোনো ধরনের কথা বলতে রাজি হয়নি কোনো ব্যক্তি। শুধু তাদের দুচোখ ছলছল করছিল।

এলাকার পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ হলেও সেখানে কোনো পুলিশের উপস্থিতি দেখা যায়নি। শুধুমাত্র নিলক্ষার প্রবেশ মুখে একটি সেতুর কাছে ৩ জন পুলিশ বসা ছিল। এলাকা থেকে পালিয়ে অনেকেই এখন অবস্থান করছেন নরসিংদী শহরসহ আশপাশের এলাকায়।

Norsingdi

জীবন রক্ষার্থে এলাকা ছাড়া আমির হোসেন মাস্টার জানান, নিলক্ষার টেটা সর্দার ছমেদ আলি, মোতালিব মেম্বার, জসিম উদ্দিন মেম্বার ও হযরত আলী মেম্বাররা অনবরত এই নারকীয় ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। আর তাদের নেতৃত্ব দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় প্রভাবশালী নেতা।

তিনি আরও জানান, প্রভাব বিস্তার ও রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্যই এই হামলার ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। কোনো অবস্থাতেই সমঝোতার ব্যবস্থা করছে না তারা। নীলক্ষা ইউনিয়নের শান্তি ফিরিয়ে আনতে তিনি সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন।

এলকার দাঙ্গা ফ্যাসাদে সবচেয়ে বেশি ফায়দা লুটছেন টেটা সর্দার ছমেদ আলী। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে তাকে গ্রেফতার করছে না পুলিশ। এক সময়ের নৌকার মাঝি দরিদ্র ছমেদ আলী এই দাঙ্গার ফলে এখন জিরো থেকে কোটিপতি। বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা আদায় করে সে। টাকা না দিলে ঝগড়ার সময় ওই বাড়িতেই হামলা চালায় তার টেটা বাহিনী।
 
যেখানে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে সেখানে এ ধরনের নৃশংস ঘটনা সত্যিই অবাক করার মতো।

পুলিশ বলছে, আমরা বারবার ওই এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও কিছু দিন পর আবার শুরু হয় দাঙ্গা। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে একাধিক। এছাড়া থানা থেকে এলাকাটির দূরত্ব বেশি বলেই সন্ত্রাসীরা বারবার হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন রায়পুরা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

রায়পুরা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাহারুল ইসলাম সরকার জানান, এলাকাটি দূর্গম চরাঞ্চল। তাছাড়া  থানা কম্পাউন্ড বহু দুরে। এছাড়া এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা এখানে থাকে না। বাহির থেকে হঠাৎ করে এসে ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে এসব চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

সঞ্জিত সাহা/এফএ/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।