রাজশাহী স্বাধীনতার স্বাদ পায় আজ

আজ ১৮ ডিসেম্বর। রাজশাহী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে রাজশাহী শত্রুমুক্ত হয়েছিল। দু’দিন আগে দেশ স্বাধীন হলেও রাজশাহীতে বিজয়ের পতাকা উড়েছিল আজকের এই দিনে। অবরুদ্ধ মানুষ এ দিন নেমে এসেছিলেন রাজশাহীর মুক্ত বাতাসে। ওইদিন তারা তাদের হারানো স্বজনদের খুঁজতে ছুটে গিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুজ্জোহা হলে। সেখান থেকে উদ্ধার হয়েছিল নির্যাতিত বাঙালির মরদেহ ও বিবস্ত্র নারী।
রাজশাহীকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন ৭ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সাব-সেক্টরের কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী (বীর বিক্রম)। মুক্তিযুদ্ধকালে রাজশাহী ছিল ৭ নম্বর সেক্টরের অধীন। সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হক শহীদ হওয়ার পর এই ৭ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব নেন কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান (বীর উত্তম)।
মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একাত্তরে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজাকার আলবদর পাকিস্তানপন্থী অবাঙালি ও দোসরদের মদদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বদ্ধভূমিতে নির্যাতন করে প্রায় তিন থেকে সড়ে তিন হাজার বন্দীকে হত্যা করে। ওই সময় ৭ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সাব-সেক্টরের (লালগোলা) কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও শেখপাড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর রশিদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর, পূর্ব পশ্চিম ও দক্ষিণে পদ্মা নদীর চরাঞ্চলে প্রতিরোধ গড়ে তুলে রাজশাহী শহরের দিকে এগুতে থাকেন।
এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকার কাছে পৌঁছে যায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর বিশাল বহর। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়তে থাকে মুখে মুখে। বেতার যন্ত্রের সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন অবরুদ্ধ স্বাধীনতাকামী বহু মানুষ। তবুও পাকিস্তান পন্থী অবাঙালিরা দাঙ্গা বাধানোর অপচেষ্টা করতে থাকে।
কিন্তু বাড়িঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে অবরুদ্ধ হয়ে থাকা স্বাধীনতাকামীরা। স্বজন হারানোর শোক যেন বিজয়ের আনন্দে উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠতে থাকে চারিদিকে। আত্মগোপনে যায় রাজাকার আলবদর ও পাকিস্তানপন্থী অবাঙালিরা। আবার মুখোশ পাল্টিয়ে বেশ কিছু দোসর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাগত জানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সাদা পতাকা উড়িয়ে সাদা পাগড়ি আর আত্মসমর্পণের বার্তা নিয়ে রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠে আসে মুক্তিবাহিনীর অগ্রগামী একটি দল।
এসময় স্বজনদের ভিড় জমে বন্দিশালার আশপাশে। বন্দিশালা থেকে বেরিয়ে আসা বন্দীরা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। স্বজন হারানো শোকে আর বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে আসা নির্যাতিত অত্যাচারিতদের অঝর অশ্রুতে সিক্ত হয় রাজশাহীর মাটি।
এদিকে বিজয়ী মক্তিযোদ্ধাদের ফুলের পাপড়ি আর গোলাপ পানি ছিটিয়ে বরণ করে নেয়া হয়। বরণ করে নেয়া হয় মিত্রবাহিনীকেও। খাদ্য সংকট যাতে না হয়, সেজন্য বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষে খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করতে থাকে। অবাঙালি মহল্লা থেকে উদ্ধার করা হয় অস্ত্র। বিভিন্ন টর্চার ক্যাম্প, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ধার করা হয় নির্যাতিত নারী পুরুষদের। স্বজন ঘনিষ্ঠরা খুঁজতে থাকেন স্বজনদের মরদেহ।
১৮ ডিসেম্বর সকালে রাজশাহীর মাদরাসা হাইস্কুল মাঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের পর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা তুলে রাজশাহীকে মুক্ত ঘোষণা করেন। এই অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি সৈন্য ও দোসরদের দ্বারা নির্যাতিত অনেকের কথা শুনে শিহরিত হয়ে উঠতে থাকেন উপস্থিতরা।
কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীকে এই অঞ্চল পরিচালনা জন্য প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়। তৎকালীন পৌরসভা ভবনকে কন্ট্রোল রুম করে পরিচালিত হতে থাকে প্রশাসন। শান্তি বজায় রাখার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকলকে আহ্বান জানানো হয়। শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/এফএ/জেআইএম