১৪ পরিবারের আশ্রয়ণ

ঘর পেয়ে স্বস্তিতে নিখিল-যুগো মায়ারা

আরিফ উর রহমান টগর আরিফ উর রহমান টগর টাঙ্গাইল
প্রকাশিত: ১০:০৪ এএম, ২৪ নভেম্বর ২০২২

বাসর চর আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই পেয়ে স্বস্তির হাসি হাসছেন গৃহহীন ১৪ সনাতন ধর্মাবলম্বী পরিবারের সদস্যরা। স্থায়ী ঠিকানাসহ এখন ওই গ্রামেই গড়ে তুলছেন নিজেদের কর্মসংস্থান। সাবলম্বী হতে বসবাসরতদের নিয়েই গড়ে তুলেছেন দূরান্ত যুব সংঘ নামে একটি সঞ্চয় সমিতি।

উপাসনার তাগিদে ওই সমিতির সঞ্চিত টাকায় এ বছর আশ্রয়কেন্দ্রে কোনো রকমে গড়ে তোলা কালিমন্দিরে করেছেন পূজাপার্বণও। পাশাপাশি স্থানীয় জনবসতিতে সুসম্পর্ক স্থাপনের নজির সৃষ্টি করেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই পাওয়া গৃহহীন হিন্দু পরিবারগুলোর সদস্যরা। বাসর চর আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই পাওয়া গৃহহীন পরিবারগুলো সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়ায় স্থানীয় মহলে এটি এখন হিন্দু আশ্রয়কেন্দ্র নামে পরিচিত।

এমন তথ্যই জানিয়েছেন টাঙ্গাইল সদর উপজেলার দাইন্যা ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের চিলাবাড়ী গ্রামের বাসর চর আশ্রয়কেন্দ্রের গৃহহীন ১৪টি হিন্দু পরিবারের সদস্য, স্থানীয় ব্যক্তিসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি।

জানা যায়, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া উপহার আশ্রয়কেন্দ্রের তালিকায় টাঙ্গাইল সদর উপজেলার দাইন্যা ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের চিলাবাড়ী গ্রামের বাসর চরে নির্মিত হয় ১৪টি পাকা ঘর। ২ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত হয়েছে এর প্রতিটি ঘর। ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মিত হলেও বাসর চর আশ্রয়কেন্দ্রে ঘটেছে কিছুটা ব্যত্যয়। অন্যান্য কেন্দ্রে একাধিক ধর্মাবলম্বী একত্রে বসবাস করা সুযোগ পেলেও বাসর চর আশ্রয়কেন্দ্রের ১৪টি ঘরে ঠাঁই পেয়েছেন শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৪টি পরিবার। বাসর চর কেন্দ্রে বসবাসরতদের তালিকা অনুসারে ৯১ নং বাড়ির মালিকানা পেয়েছেন লক্ষ্মী রানী দাস, ৬ নং বাড়ির মালিকানা পেয়েছেন ঝর্না রানী দাস, ১৫৬ নং বাড়ির মালিকা পেয়েছেন নির্মল চন্দ্র দাস, ৪ নং বাড়ির মালিকানা পেয়েছেন সুভ্যাগি পাল, ৫ নং বাড়ির মালিকানা পেয়েছেন নিখিল চন্দ্র সূত্রধর, ২২০ নং বাড়ির মালিকানা পেয়েছেন উজ্জ্বল চন্দ্র দাস, ১১৬ নং বাড়ির মালিকানা পেয়েছেন প্রভাতী রানী দাস, ১৪৩ নং বাড়ির মালিকানা পেয়েছেন সুমিতা দাস, ৭০ নং বাড়ির মালিকানা পেয়েছেন মনিন্দ্র চন্দ্র দাস, ৬৬ নং বাড়ির মালিকানা পেয়েছেন নিতাই চন্দ্র দাস, ১৪৯ নং বাড়ির মালিকানা পেয়েছেন যুগো মায়া দাস, ১৬৩ নং বাড়ির মালিকানা পেয়েছেন চন্দনা পাল, ৬৭ নং বাড়ির মালিকানা পেয়েছেন বিষ্ণু চন্দ্র দাস আর ১৭৮ নং বাড়ির মালিকানা পেয়েছেন রাম চন্দ্র দাস।

প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘায়ু কামনা করে তিন সদস্য নিয়ে বাসর চর আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসরত সুভ্যাগি পাল বলেন, আমরা ভূমিহীন ও কষ্টে ছিলাম; মা (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের থাকার ঘর করে দিয়েছেন। এখানে বসবাসরত ১৪টি ঘরের সবাই হিন্দু হওয়ায় আমরা অনেক খুশি। এছাড়া স্থানীয় মুসলমানরা আমাদের প্রতিবেশী হিসেবে মেনে নিয়েছেন, এটি আরও বেশি আনন্দের। এখানে আমরা অনেক শান্তিতে আছি।

ঝর্না রানী দাস বলেন, দেড় বছর ধরে নির্মিত বাসর চর আশ্রয়কেন্দ্রে আমরা স্বামী-স্ত্রী বসবাস করছি। গরিব মানুষ, এরপরও ভাড়া বাসায় থাকতে হতো আমাদের। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়ে এখন আমাদের ভাড়া থাকার কষ্ট দূর হয়েছে। জমি-ঘর কিছুই ছিল না, প্রধানমন্ত্রী আমাদের সেটি পূরণ করেছেন। কেন্দ্রে আমরা কালিমন্দির নির্মাণ করে কার্তিক মাসের ৬ তারিখ পূজা করেছি। স্থানীয় মুসলমানদের সাথে আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসরত ৭০ জন সদস্যের অনেক ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তবে আশ্রয়কেন্দ্রে টিউবওয়েলের পানিতে আয়রন থাকাসহ বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ার কিছু সমস্যা রয়েছে বলে জানান তিনি।

মনিন্দ্র চন্দ্র দাস বলেন, বাসর চরে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহারের একটি ঘর পেয়েছি। ঘর পাওয়ার পর স্থানীয়দের সহযোগিতায় চিলাবাড়ী বটতলা ঈদগাঁ মাঠের কাছে একটি চায়ের দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছি। দোকানের বেশির ভাগ ক্রেতাই মুসলমান। আমাদের সবাই খুব সহযোগিতা করছেন। তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে এখন অনেক ভালো আছি।

তিনি আরও বলেন, গৃহহীন থাকায় শহরে বাসাভাড়া করে থাকতে হতো, বাসাভাড়াসহ পরিবারের খরচ জোগার করতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে। এখন জমি-ঘর দুটি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমি তার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনাসহ দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

বাসর চর আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দা ও দূরান্ত যুব সংঘ সঞ্চয় সমিতির সভাপতি চিত্তরঞ্জন পাল বলেন, এখানে আমরা ১৪টি হিন্দু পরিবার দেড় বছর ধরে বসবাস করছি। সাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আমরা দূরান্ত যুব সংঘ নামে একটি সঞ্চয় সমিতি করেছি। প্রতি সপ্তাহে ঘরের মালিকরা নিজ তাগিদে একশ করে টাকা জমা রাখেন। ১৫ সপ্তাহ ধরে আমরা সঞ্চয় করছি। ১৪টি ঘরের মানুষই যেন একটা সময় সাবলম্বী হতে পারি এ উদ্যোগেই আমাদের সমিতি গঠন করা।

তিনি বলেন, উপজেলা প্রশাসনের কাছে স্থায়ী মন্দিরের জন্য আবেদন করা হয়েছে। এরপরও চলতি বছর অনুমতি নিয়ে সমিতির জমানো টাকায় এখানে আমরা একটা ছাপড়াঘর দিয়ে কালিমন্দির নির্মাণসহ পূজাপার্বণ করেছি।

চিলাবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা হাসমত বলেন, বাসর চরে বসবাসরতরা আমাদের প্রতিবেশী ও ভাই। এই গ্রামের মানুষের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম কোনো ভেদাভেদ নেই। তাদের আমরা আপন মানুষই মনে করি। এরপরও তাদের কোনো সমস্যা হলে আমরা সার্বিকভাবে সহযোগিতা করবো।

দাইন্যা ইউনিয়ন পরিষদের ৪নং ওয়ার্ড সদস্য শহীদ সরকার বলেন, এরইমধ্যে ঘরপ্রতি এক বস্তা করে চাল দেওয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো দেখভালের দায়িত্ব উপজেলা প্রশাসনের। ইউনিয়ন পরিষদকে সহযোগিতার কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। ভোটার হওয়ার পর সহযোগিতার কিছু সুযোগ সৃষ্টি হবে বলেই আমি তাদের এ ওয়ার্ডের ভোটার করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সহযোগিতা চেয়েছি। তিনি আশ্বাসও দিয়েছেন।

ইউপি সদস্য আরও বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস সত্ত্বেও তারা এখানে একটি মন্দির করার উদ্যোগ নিয়েছে দেখে আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। মন্দিরটি পাকা করতে আমি আর্থিক সহযোগিতা করবো। এছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে অনুদান এনে দেওয়ার চেষ্টা করবো।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রানুয়ারা খাতুন জানান, তালিকা অনুযায়ী তারা ঘরগুলো পেয়েছেন। এছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রে স্থায়ী মন্দির নির্মাণের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। স্থায়ী মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিলে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের সৃষ্টি হবে।

হিন্দুদের মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিলে মুসলমানরা মসজিদ নির্মাণের দাবি জানাবেন। তবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর জন্য কবরস্থানের জমি খোঁজা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এসএইচএস/এএসএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।