পেঁয়াজ উৎসবে কৃষকের মুখ ভার
দেশের সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনকারী জেলা পাবনার মাঠে মাঠে নতুন হালি পেঁয়াজ উঠতে শুরু করেছে। তবে বাজারদরে খুশি নন চাষিরা। তাদের দাবি, খুচরা বাজারে যে দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে সে অনুপাতে চাষিরা দাম পাচ্ছেন না।
মুখে হাসি না থাকলেও পেঁয়াজ তুলতে ব্যস্ত চাষিরা। মাঠ থেকে পেঁয়াজ তোলা, চাষির ঘরে নেওয়া, পেঁয়াজ কাটা আবার নতুন পেঁয়াজ হাটে নিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। সব মিলিয়ে পেঁয়াজ তোলা নিয়ে জেলা জুড়ে রীতিমতো উৎসব শুরু হয়েছে।
পাবনার সুজানগর, সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলার মাঠের পর মাঠ জুড়ে এখন পাকা পেঁয়াজের ক্ষেত। চাষিরা পেঁয়াজ তুলতে মহাব্যস্ত। কারণ তাদের মনে আশংকা পাকা পেঁয়াজ যেন শিলা-বৃষ্টিতে নষ্ট না হয়।
শুক্রবার (৩১ মার্চ) সাঁথিয়া উপজেলার বিল গ্যারকা ও গাজনা পাড়ের বড় বড় মাঠে গিয়ে চাষিদের সঙ্গে কথা হয়। চাষিদের ভাষ্য, তারা লাভবান হচ্ছেন না। কারণ খুচরা বাজারে যে দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে সে দরতো তারা পাচ্ছেন না। তারা প্রতিমণ পেঁয়াজে ৯০০-১১শ’ টাকা পাচ্ছেন। উৎপাদন খরচ বাদ দিলে লাভ বলে কিছু থাকছে না। আবার পেঁয়াজের ফলনও ভালো হয়নি বলে জানিয়েছেন তারা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পাবনা জেলায় এবার ৫২ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে হালি (চারা) ও কন্দ পেঁয়াজ চাষ হয়েছে। হালি পেঁয়াজের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৯০ হাজার ৪৪৫ মেট্রিক টন। ২০২২ সালে জেলায় ৫৩ হাজার তিনশ পাঁচ হেক্টর জমিতে হালি (চারা) পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেদিক থেকে এবার গত বছরের তুলনায় প্রায় ১ হাজার হেক্টর কম জমিতে পেঁয়াজচাষ হয়েছে। দাম না বাড়লে আগামী বছর পেঁয়াজচাষ আরও কমবে বলে জানিয়েছেন চাষিরা।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছর পেঁয়াজচাষে ক্ষতির শিকার হওয়ায় চাষিরা এবার পেঁয়াজ আবাদ একটু কমিয়ে দিয়েছেন।
আর কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এ বছর চাষিরা সরিষা আবাদে ঝুঁকে পড়ায় পেঁয়াজের আবাদ কিছুটা কমেছে।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, দেশে প্রতিবছর পেঁয়াজের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন। পাবনা জেলা থেকেই উৎপাদন হয় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টন যা মোট উৎপাদনের এক চতুর্থাংশ। আর পাবনা জেলার সাঁথিয়া-সুজানগর উপজেলা থেকে উৎপাদন হয় প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ টন। সে হিসাবে সারা দেশে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের এক পঞ্চমাংশ উৎপাদিত হয় পাবনার এ দুটি উপজেলা থেকে।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাটে প্রতি মণ পেঁয়াজ ৯০০ থেকে ১১০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। খুব বড় আকারের ও ভালো মানের কিছু পেঁয়াজ ১২শ’ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।
চাষিরা জানান, এবার মূলকাটা বা মুড়ি পেঁয়াজ চাষে চাষিরা কিছুটা লাভবান হয়েছেন। তবে হালি পেঁয়াজে তারা লাভবান হচ্ছেন না।
সাঁথিয়ার পদ্মবিলা গ্রামের পেঁয়াজচাষি ডাবলু সেখ জানান, পেঁয়াজ চাষ করে তারা লাভবান হতে পারছেন না। কারণ পেঁয়াজ চাষের উপকরণ যেমন সার, বীজ, চাষের খরচ, শ্রমিক খরচ বেড়ে গেছে। এমনকি এক বস্তা পেঁয়াজ মাঠ থেকে বাড়ি নিতেও ৭০ টাকা চলে যাচ্ছে। পেঁয়াজ কাটাতে নারী শ্রমিকদের খরচ দিতে হয় প্রতি মণে ৩০-৪০ টাকা। এরপর হাটে নিতে আরও খরচ ২০ টাকা। হাটের খাজনা দিতে হয়। সে হিসাবে উৎপাদনের পরও তাদের প্রতিমণ ১০০ টাকা বাড়তি খরচ চলে যাচ্ছে।
তিনি জানান, তার জমি লিজ নেওয়া। এজন্য তার উৎপাদন খরচ আরও বেশি। এতে পেঁয়াজের বাজার দর অনুযায়ী তার অনেক টাকা ক্ষতি হচ্ছে। এর মধ্যে মৌসুমের শেষে বৃষ্টি হওয়ায় তাদের উৎপাদনে আরও ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থায় পেঁয়াজ আমদানি হলে চাষিদের ভাত বিনে মরতে হবে।
ইসলামপুর গ্রামের বড় পেঁয়াজচাষি ইব্রাহিম হোসেন জানান, যে শ্রমিক খরচ হয়েছে ও চাষের যে খরচ তাতে প্রতি মণ ১১শ’ টাকা দর পেলে চাষির পোষায় না। মৌসুমের শুরুতে যদি দুই হাজার টাকা মণ বাজার দর থাকে তাহলে তাদের লাভ হতো।
তিনি জানান, প্রতি বছরই যদি ক্ষতি বা উৎপাদন খরচের সমান দাম ওঠে তাহলে তারা কিভাবে পেঁয়াজ চাষ করবেন। তিনি সরকারে কাছে এলসি বন্ধ ও চাষের উপকরণের দাম কামানোর দাবি জানান।
বাংলাদেশ ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) কেন্দ্রীয় সভাপতি ও পাবনা জেলার বিশিষ্ট চাষি আলহাজ্ব শাহজাহান আলী বাদশা জানান, বছরের শেষ দিকে অনেক সময় পেঁয়াজের দাম বাড়ে। তবে সে দাম সাধারণ চাষিরা পান না। কারণ চাষের খরচজনিত দেনার কারণে তাদের মৌসুমের শুরুতেই সিংহভাগ পেঁয়াজ বেচে ফেলতে হয়।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম জানান, এবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েননি চাষিরা। তাই তারা বেশ নিরাপদেই পেঁয়াজ ঘরে তুলতে পারছেন। এবার চাষিরা লাভবান হবেন বলে কৃষি বিভাগ ধারণা করছে।
এত কিছুর পরও পেঁয়াজ উৎসব থেমে নেই। চাষির বাড়িতে মহিষের গাড়ি, ভ্যান, অটোবাইক, নছিমন, করিমন আর ঘোড় গাড়িতে পেঁয়াজ আসছে। তারা বাড়তি কিছু টাকাও উপার্জন করছেন। পেঁয়াজ তোলার জন্য অন্য জেলার শ্রমিকরা শ্রম বেচতে এসেছেন। রাত জেগে কৃষাণ বধূরা পেঁয়াজ কাটছেন, মাচায় তুলছেন। পেঁয়াজ মৌসুমে শুধু পেঁয়াজ কেটে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেক নারী। এদের অনেকে প্রতি মৌসুমে ২০-২৫ হাজার টাকা পান পেঁয়াজ কেটে।
এফএ/এমএস