বাবার উৎসাহে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন নবম শ্রেণির ছাত্রী মধুমিতা
বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে কিশোরদের পাশাপাশি অংশ নেন কিশোরীরাও। তবে তাদের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে প্রায় দুই হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাদের মধ্যে ছিলেন মধুমিতা বৈদ্য ও আলো রাণী বৈদ্য নামের কিশোরী দুই বোন।
২০১৭ সালের ৫ মে আলো রাণী বৈদ্য পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। বর্তমানে মিরসরাই উপজেলার একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা মধুমিতা বৈদ্য। তিনি ৩ নম্বর জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের গোপীনাথপুর গ্রামে ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ক্ষিতীশ চন্দ্র বৈদ্য ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের সৈনিক। মায়ের নাম মালতী রানী বৈদ্য। স্বামী বাদল চন্দ্র দে।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে মধুমিতা বৈদ্য বলেন, ‘তখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্রী। বয়স মাত্র ১৫ বছর। পড়তাম মিরসরাইয়ের আবুল কাশেম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমার বাবা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। আর আমি অনেক ভালোবাসি আমার দেশকে। এ দুইয়ের সম্মিলনেই আমার যুদ্ধে যাওয়া। মূলত বাবাই আমাকে অনুপ্রেরণা জোগান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে। তিনি চেয়েছিলেন, আমি যেন অন্তত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাই।’
যুদ্ধের শুরুতেই ফেনীর ছাগলনাইয়ার সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি দেন ভারতের শ্রীনগর ক্যাম্পে। সেখানে ১ নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের সহযোগিতায় বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালের দেশরক্ষা বিভাগে যোগ দেন। সেখানে তাদের সঙ্গে ছিলেন কবি সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে টুলু ও লুলু। ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন ছিলেন বেগম সিতারা। এ ক্যাম্পে শত শত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা দিয়েছেন মধুমিতা।

তাঁদের মতো মহান বীরদের সেবা দিতে পেরে আমি খুব গর্ববোধ করি। প্রথম যাঁর সেবা করেছি তিনি ছিলেন আমাদের মিরসরাইয়ের অধিবাসী, তাঁর নাম শেখ আলম। এরপর আমি যখন মেডিক্যাল ওয়ার্ডে চলে যাই, তখনও আমাদের মিরসরাইয়ের নিজামপুর কলেজ এলাকার জ্ঞান বিকাশ বড়–য়াকে সেবা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তিনি ছিলেন আমার সুপরিচিত। সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতি রোমন্থন করে মধুমিতা বৈদ্য বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিতে গিয়ে আমাদের তেমন কোনো অসুবিধায় পড়তে হয়নি। তবে প্রথমদিকে একবার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রশিক্ষণ শেষে ক্যাম্পে যাওয়ার পথে আমাদের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছিল। আমরা সৌভাগ্যক্রমে সেদিন রক্ষা পেয়েছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর আমরা বিজয়িনীর বেশে দেশে ফিরি। দেশের অবস্থা তখন খুবই নাজুক। সাজানো-গোছানো দেশটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাংলার পথ-প্রান্তর তখনো রক্তে রাঙানো। সবুজ মাঠে লেগে আছে লাল রক্ত। আমি বসে থাকিনি। দেশ রক্ষার পর এবার শুরু হলো দেশ গড়ার কাজ। প্রথমদিকে নরওয়ে এবং শেষে সুইজারল্যান্ডের টিমের সঙ্গে আমি যুক্ত হই। তাদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের শুশ্রুষা দিই। নানাভাবে সহায়তা করি।’
‘আমার বাবা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের সৈনিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি চলে আসেন গ্রামে। আগে থেকেই আমরা এলাকার মানুষদের মধ্যে নানান সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চালাই। বাবাই সবসময় আমাকে সাহস জুগিয়েছেন’, যোগ করেন মধুমিতা বৈদ্য।
এসআর/এএসএম