নির্বাচনী ইশতেহারে থাকতে হবে অর্থনৈতিক সংস্কারের রূপরেখা
অর্থনৈতিক সংস্কারের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রতিশ্রুতির ওপর। নীতিমালা পরিবর্তন, আধুনিক সংস্কার বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনীয় কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে রাজনৈতিক নেতাদের দৃঢ় অঙ্গীকার থাকতে হবে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে তারা অর্থনৈতিক সংস্কারে কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ক্ষমতায় এলে কী পদক্ষেপ নেবে। সেই সঙ্গে এটা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে থাকতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্তিতে সংস্কার উদ্যোগ ও এর বাস্তবায়ন পরিস্থিতি নিয়ে জাগো নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশেষ সংবাদদাতা ইব্রাহীম হুসাইন অভি।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জনগণের কাছে তাদের পরিকল্পনা ও অঙ্গীকার পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা জরুরি। একইসঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে জনগণ সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারে। রাজনৈতিক ঐক্য এবং স্বচ্ছতা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংস্কার সফল হওয়া কঠিন।
- আরও পড়ুন
দুর্বল সরকার সফল দরকষাকষি করেছে, ইতিহাসে এ নজির খুব কম - ‘কিছুটা ভুল উপায়ে’ বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্য সমন্বয় করা হচ্ছে: সিপিডি
- এনবিআর সংস্কার না হলে রাজস্ব ঘাটতি থাকবেই: সিপিডি
- বাজেট সংস্কারবিমুখ ও সাম্যবিরোধী: দেবপ্রিয়
জাগো নিউজ: গত এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে দেশের অর্থনীতিতে কোন কোন ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে এবং কোথায় আরও উন্নতির সুযোগ ছিল?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: অর্থনীতিতে অগ্রগতির চিত্র আমরা মূলত তিনভাবে দেখতে পারি। কিছু ক্ষেত্রে শুধু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কিন্তু এখনো দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে ইতিবাচক পরিবর্তনও এসেছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে এখনো কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
আগস্টের পর যখন নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে, তখন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক এবং প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সূচক নিম্নমুখী ছিল। এ পরিস্থিতিতে সরকারের প্রথম কাজ ছিল অর্থনৈতিক সূচকের অবনতির ধারা থামানো এবং দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতার জন্য কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার শুরু করা। সরকার সেটা শুরু করেছিল এবং কিছু ফলাফল এসেছেও।

বিশেষ করে ব্যাংকখাতে বেশ কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন, ব্যাংকের সম্পদমান মূল্যায়ন, আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে নিরীক্ষা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এই টাস্কফোর্সগুলোর কাজ ছিল ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক অবস্থা ও ঋণ খেলাপির চিত্র নিরূপণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করা এবং ব্যাংকখাত থেকে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া।
দুর্বল ব্যাংকগুলো পুনরুজ্জীবিত করতে মার্জার বা অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে পুনর্গঠনের পরিকল্পনাও রয়েছে। এর পাশাপাশি ব্যাংক রেগুলেশন অর্ডিন্যান্স ২০২৫ প্রণীত হয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদের হার বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পতন ঠেকানো, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার মতো পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। তবে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং কর আদায়ের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত অগ্রগতি এখনো আসেনি।
- আরও পড়ুন
বাজেট অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়: সিপিডি - শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি বরাদ্দ প্রয়োজন: সিপিডি
- কালো টাকা সাদা করার সুযোগ জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক: সিপিডি
- নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ দেওয়ার সময় এসেছে: সিপিডি
জাগো নিউজ: বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে কোন বড় প্রতিবন্ধকতাগুলো এখনো রয়ে গেছে?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: বিনিয়োগ বাড়াতে দেশি-বিদেশি উভয় পক্ষেরই আগ্রহ সীমিত, যার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করছে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিনিয়োগ প্রক্রিয়া দীর্ঘ করছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির সরবরাহে সমস্যা বিনিয়োগের পরিবেশ দুর্বল করছে, আর দুর্নীতি ও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতাও বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর সঙ্গে উচ্চ সুদের হার যুক্ত হওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
বিনিয়োগ না বাড়ায় কর্মসংস্থানও বাড়ছে না। ফলে ছাত্রদের আন্দোলনের অন্যতম মূল দাবি— চাকরির সুযোগ বাড়ানো, এখনো পূরণ হয়নি। এবং বেকারত্ব সমস্যা সমাধানের দিকে কোনো বাস্তব অগ্রগতি দেখা যায়নি।
জাগো নিউজ: রাজস্ব আদায় ও কর সংস্কারের ক্ষেত্রে কী অবস্থা?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: কর আদায়ের জিডিপি অনুপাত এখনো খুবই কম এবং এখাতে অগ্রগতি সীমিত। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অভাব এর প্রধান কারণ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দুই ভাগে ভাগ করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। কর ফাঁকি রোধ ও রাজস্ব সংগ্রহ বাড়াতে ডিজিটালাইজেশন ও অটোমেশন অত্যন্ত জরুরি হলেও এক্ষেত্রে কার্যক্রম এখনো পূর্ণ গতি পায়নি। ফলস্বরূপ রাজস্ব আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি।
জাগো নিউজ: সামনে অর্থনৈতিক সংস্কার টেকসই করতে কী কী করা জরুরি?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: যেসব ক্ষেত্রে প্রয়োজন সেখানে অবশ্যই আইন প্রণয়ন করতে হবে। কারণ আইন একবার হলে সেটি পরিবর্তন করা সহজ নয়, ফলে নীতির স্থায়িত্ব থাকে। ব্যাংক রেগুলেশন অর্ডিন্যান্সের মতো উদ্যোগ এজন্য গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি কর আদায়, সরকারি প্রকিউরমেন্ট এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। ডিজিটালাইজেশন ও অটোমেশন দুর্নীতি ও অদক্ষতা কমাবে। এসব প্রক্রিয়া একবার চালু হলে তা পিছিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ, অনলাইন ব্যাংকিং আজ মানুষের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। তাই ভবিষ্যতে কোনো সরকার সহজে এটি বাতিল করতে পারবে না। অর্থনৈতিক সংস্কারে প্রযুক্তি ও আইনের সমন্বয় দীর্ঘমেয়াদি সুফল দেবে।
- আরও পড়ুন
পুঁজিবাজারে সংকট চলমান রয়েছে: সিপিডি - মার্কিন শুল্ক ইস্যু মোকাবিলায় কূটনৈতিক-কৌশলগত উদ্যোগ জরুরি
- কারিগরি শিক্ষার্থীরা যা শিখছেন, চাকরির বাজারে তার চাহিদা নেই
- ২০২৩ সালে কর ফাঁকির পরিমাণ ২ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা
জাগো নিউজ: আগামী সরকার বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: অর্থনৈতিক সংস্কারের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রতিশ্রুতির ওপর। নীতিমালা পরিবর্তন, আধুনিক সংস্কার বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনীয় কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে রাজনৈতিক নেতাদের দৃঢ় অঙ্গীকার থাকতে হবে। আসন্ন নির্বাচনের আগে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে তারা অর্থনৈতিক সংস্কারে কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ক্ষমতায় এলে কী পদক্ষেপ নেবে। জনগণের কাছে তাদের পরিকল্পনা ও অঙ্গীকার পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা জরুরি। একইসঙ্গে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে জনগণ সরকারের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারে। রাজনৈতিক ঐক্য এবং স্বচ্ছতা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংস্কার সফল হওয়া কঠিন।
এছাড়া জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সরকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে মানুষ প্রতিবাদ জানাতে পারে।
আইএইচও/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম