কেমন যাবে নতুন বছর

বৈশ্বিক বাণিজ্যে জটিলতা আরও বাড়বে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:২৩ পিএম, ২২ ডিসেম্বর ২০২৫
নতুন বছরে বৈশ্বিক বাণিজ্যে জটিলতা আরও বাড়বে/ প্রতীকী ছবি: এআই দিয়ে তৈরি

মুক্ত বাণিজ্যের জন্য ২০২৫ সাল ছিল বেশ কঠিন। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক শুল্ক আরোপ করলে বৈশ্বিক বাণিজ্যে বড় ধাক্কা লাগে। মিত্র-প্রতিদ্বন্দ্বী সবার ওপরই শুল্ক আরোপ করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর ফলে নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার অবশিষ্ট কাঠামো কার্যত ভেঙে পড়ে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিওর দুর্বলতা আরও স্পষ্ট হয়, আর যুক্তরাষ্ট্র যে আর এই ব্যবস্থার অভিভাবক নয়, সেটিও নিশ্চিত হয়ে যায়।

তবে যুক্তরাষ্ট্র শতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ গড় শুল্ক আরোপ করলেও বৈশ্বিক বাণিজ্য পুরোপুরি থেমে যায়নি। অক্টোবর মাসে ডব্লিউটিও ২০২৫ সালে পণ্য বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস বাড়িয়ে ২ দশমিক ৪ শতাংশে উন্নীত করে, যা বছরের শুরুতে ছিল মাত্র ০ দশমিক ৯ শতাংশ। রপ্তানিকারকেরা দ্রুত মানিয়ে নিতে শুরু করেছে।

ট্রাম্পের শুল্কের প্রধান লক্ষ্য চীন হলেও ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে দেশটির রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ছয় শতাংশ বেড়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ১৫ শতাংশের বেশি কমেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে তা বেড়েছে প্রায় আট শতাংশ, দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর জোট আসিয়ানে এক-ষষ্ঠাংশ এবং আফ্রিকায় প্রায় এক-চতুর্থাংশ। চীন তার শিল্পপণ্যের উদ্বৃত্ত অন্য বাজারে ঘুরিয়ে দিচ্ছে।

আরও পড়ুন>>
কেমন যাবে ২০২৬/ সোনায় সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়লেও কমতে পারে তেলের দাম
আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে ডলারের আধিপত্য
শঙ্কা-বিধিনিষেধ পেরিয়ে নতুন উত্থান দেখবে পর্যটন শিল্প
অল্প দামে হাতের কাছেই মিলবে ওজন কমানোর ওষুধ

চীনের পথ ধরে অন্য দেশগুলোও নিজেদের রপ্তানি গন্তব্য বদলাচ্ছে। ভিয়েতনাম ইউরোপে আরও বেশি কৃষিপণ্য পাঠাচ্ছে, ভারত উপসাগরীয় দেশগুলোতে বস্ত্র রপ্তানি বাড়াচ্ছে, আর ব্রাজিল চীনে আরও বেশি গরুর মাংস বিক্রি করছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই অভিযোজনেরও সীমা আছে।

বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ

২০২৬ সালে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কপ্রাচীর এবং চীনের শিল্প উৎপাদনের অতিরিক্ত জোগানের বিপরীতে বাকি বিশ্ব কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায়, তার ওপর। অনেক দেশের কাছে সুরক্ষাবাদই এখন সবচেয়ে সহজ পথ হয়ে উঠছে। ট্রাম্পের সন্তুষ্টি ধরে রাখতে মেক্সিকো এরই মধ্যে চীনা গাড়ির উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক ঘোষণা করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আশঙ্কা করছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজার বন্ধ হলে ইউরোপে সরিয়ে আনা পণ্যের ঢল নামাতে পারে। তাই তারা ইস্পাত কোটা প্রায় অর্ধেকে নামানো এবং শুল্ক বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশও চীনা পণ্যের চাপ থেকে স্থানীয় শিল্প রক্ষার উপায় খুঁজছে।

একই সঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদার বিকল্প বাজার খুঁজতে গিয়ে বাণিজ্য কূটনীতির নতুন রূপ নিচ্ছে। ট্রাম্পের শুল্কনীতির পর অনেক দেশ দ্রুত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে চাইছে, যাতে দীর্ঘমেয়াদি বাজার নিশ্চিত করা যায়। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সবচেয়ে সক্রিয়। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পরপরই ইইউ ২৫ বছর ঝুলে থাকা মারকোসুর (দক্ষিণ আমেরিকান জোট) জোটের সঙ্গে চুক্তি করে, যদিও তা এখনো অনুমোদিত হয়নি। ইইউ ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গেও চুক্তি চূড়ান্ত করেছে এবং ২০২৬ সালের শুরুতে ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে চুক্তির আশা করছে।

ব্রাজিল কানাডার সঙ্গে আলোচনা পুনরুজ্জীবিত করেছে, জাপানের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছে এবং ২০২৬ সালে মেক্সিকোর সঙ্গে চুক্তির প্রত্যাশা করছে। কানাডা ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে চুক্তি সই করেছে এবং আসিয়ানের সঙ্গে আলোচনা শেষ করতে চায় আগামী বছরে।

ডব্লিউটিওর কী হবে?

দ্বিপাক্ষিক চুক্তির পাশাপাশি নিয়মভিত্তিক বাণিজ্যব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার চেষ্টাও চলছে। ডব্লিউটিও দুর্বল হলেও এখনো পুরোপুরি অচল হয়নি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও এর কিছু অংশ বাঁচিয়ে রাখতে আগ্রহ দেখাচ্ছে—ডিজিটাল রপ্তানিতে শুল্ক না আরোপের স্থগিতাদেশ বাড়ানো এবং একজন রাষ্ট্রদূত নিয়োগের চেষ্টা তার উদাহরণ। ছোট অর্থনীতির দেশগুলো মামলা দায়ের করছে এবং সংস্কারের দাবি জানাচ্ছে। চীন উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ব্রাজিল থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বহু দেশ ডব্লিউটিওকে শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে। তবে সংস্কার হবে ধীরগতির।

বিশ্লেষকদের মতে, নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থার এখন একজন শক্তিশালী অভিভাবক দরকার। প্রশ্ন হলো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কি সেই ভূমিকা নেবে। কেউ কেউ প্রস্তাব দিয়েছেন, ইইউকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাণিজ্য চুক্তি সিপিটিপিপির সঙ্গে যুক্ত করার। এই জোটে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চিলি, জাপান ও মেক্সিকোসহ ১২টি দেশ রয়েছে, যাদের সম্মিলিত অর্থনীতি বৈশ্বিক জিডিপির ১৪ শতাংশ। তবে এমন বৃহৎ জোট গঠনের সম্ভাবনা আপাতত ক্ষীণ।

সব মিলিয়ে ২০২৬ সালে বৈশ্বিক বাণিজ্যে বিভাজন আরও বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে মুক্ত ও নিয়মভিত্তিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টাও চলতে থাকবে।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
কেএএ/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।