কেমন যাবে নতুন বছর

২০২৬ সালে যে ৭ সংঘাতে নজর থাকবে বিশ্বের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:২২ পিএম, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫
২০২৬ সালে ৭ সংঘাতে নজর থাকবে বিশ্বের/ ফাইল ছবি: তাস

গত এক দশকে বিশ্বজুড়ে সক্রিয় সশস্ত্র সংঘাতের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব সংঘাত ভয়াবহ প্রাণহানির কারণ হয়েছে। আবার কিছু দ্বন্দ্ব এখনো পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ নেয়নি, কিন্তু সেগুলো বিস্ফোরিত হলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চল তো বটেই, পুরো বিশ্বব্যবস্থাই বড় ধাক্কা খেতে পারে। ২০২৬ সালে এমন সাতটি সংঘাত আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বিশেষ নজরে থাকবে।

চীন-তাইওয়ান

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কি নিজের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে তাইওয়ান ইস্যুতে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন—এই প্রশ্নই এখানে মূল। ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ থেকে বেইজিং হয়তো সামরিক সংঘাতের জটিলতা সম্পর্কে সতর্কবার্তা পেয়েছে। তবে চীন ও তাইওয়ানের সামরিক সক্ষমতার বিশাল ব্যবধান বেইজিংকে ঝুঁকি নিতে প্রলুব্ধ করতে পারে, বিশেষ করে যদি তাইওয়ানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দুর্বল মনে হয় বা সামরিক অভিযানের অর্থনৈতিক খরচ কমে আসে। সেক্ষেত্রে, সরাসরি আক্রমণের চেয়ে নৌ অবরোধের আশঙ্কাই আপাতত বেশি, যদিও তাতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সামরিক হস্তক্ষেপ এবং অর্থনৈতিক পাল্টা ব্যবস্থার ঝুঁকিও রয়েছে।

ভারত-পাকিস্তান

দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশ সম্প্রতি বড় ধরনের সংঘর্ষের কিনারা থেকে ফিরেছে, কিন্তু মূল বিরোধ এখনো অমীমাংসিত। ২০২৫ সালের এপ্রিলে ভারতে ২৬ পর্যটক নিহত হওয়ার ঘটনায় শুরু হয় কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর সংকট। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পাল্টাপাল্টি হামলায় প্রাণহানি অর্ধশত ছাড়ায়, পরে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয়। পাকিস্তানে ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির ক্ষমতা আরও দৃঢ় করছেন, আর ভারতের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দুই দেশের প্রচলিত সামরিক সক্ষমতার ব্যবধান বাড়াচ্ছে। দু’পক্ষের মধ্যে প্রায়ই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেওয়া যুক্তরাষ্ট্র শুল্কযুদ্ধের কারণে ভারতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছে। সর্বশেষ সংকটে ভারত-পাকিস্তান উভয় পক্ষই আগের তুলনায় কম সংযম দেখিয়েছে, যা ২০২৬ সালে উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে।

রাশিয়া-ইউক্রেন

রাশিয়ার হতাহতের সংখ্যা এখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতির চেয়েও বেশি বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে তারা ইউক্রেনের মাত্র ১ দশমিক ৩ শতাংশ অতিরিক্ত ভূখণ্ড দখল করতে পেরেছে। এই ক্ষয়ক্ষতির হিসাব বলছে, ২০২৬ সালে যুদ্ধের হয় ধীরগতির অগ্রগতি চলবে, নয়তো ক্লান্তির কারণে সংঘাত ঝিমিয়ে পড়বে, অথবা কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে। তবে দুটি চরম দৃশ্যপটের আশঙ্কাও রয়েছে—ক্রেমলিনের প্ররোচনায় ইউক্রেনের সামরিক বা রাজনৈতিক ভাঙন দেখা দিতে পারে, অথবা ধারাবাহিক বিমানহামলায় রাশিয়ার তেলশিল্প বিপর্যস্ত হয়ে অর্থনীতিতে বড় ধস নামতে পারে। এর যে কোনোটিই ইউরোপসহ গোটা বিশ্বের ওপর বড় প্রভাব ফেলবে।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন

ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের মধ্যে নাজুক যুদ্ধবিরতি টিকে থাকবে কি না—এই প্রশ্নের উত্তর এখনো অনিশ্চিত। গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, নিহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। ইসরায়েল এখনো ভূখণ্ডের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, আর হামাস নিরস্ত্র হয়নি। অক্টোবরের যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের অভিযোগ দুই পক্ষই তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি শান্তি পরিকল্পনায় সক্রিয় থাকেন এবং আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন হয়, তাহলে গাজা পুনর্গঠন শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সবচেয়ে সম্ভাব্য চিত্রটি হলো—বিভক্ত গাজা, ভোগান্তিতে থাকা ফিলিস্তিনিরা এবং সহিংসতার এক অস্থায়ী বিরতি, যা যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে।

কঙ্গো-রুয়ান্ডা

জাতিগত বিরোধ ও পূর্ব কঙ্গোর খনিজ সম্পদ নিয়ে কয়েক দশকের পুরোনো উত্তেজনা পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। ২০২৫ সালে রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামের শাসনে দেশটি এম২৩ বিদ্রোহীদের অস্ত্র, সহায়তা ও দিকনির্দেশনা দিয়ে গোমা শহর দখলে সহায়তা করেছে এবং নিজস্ব সেনাও পাঠিয়েছে। এতে প্রক্সির মাধ্যমে রুয়ান্ডার প্রভাবিত এলাকা কার্যত দ্বিগুণ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে স্বাক্ষরিত সাম্প্রতিক চুক্তিতে এম২৩ অন্তর্ভুক্ত না থাকায় পরিস্থিতি জটিল। উগান্ডার সেনারাও কঙ্গোতে তৎপরতা বাড়িয়েছে। স্বর্ণ, তেল, গ্যাস ও ব্যাটারি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ কোবাল্ট এই সংঘাতের পেছনে বড় অর্থনৈতিক প্রণোদনা হিসেবে কাজ করছে।

সুদান

সুদানের সেনাবাহিনী ও র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে তীব্র লড়াই অব্যাহত রয়েছে। দারফুর ও পশ্চিম সুদানের বড় অংশ আরএসএফের দখলে, রাজধানী ও পূর্বাঞ্চল সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত, অনেকে দুর্ভিক্ষের মুখে। মিশর সুদানের সেনাবাহিনীকে এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত আরএসএফকে সমর্থন দিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সংঘাত আফ্রিকার সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটে পরিণত হয়েছে। তবে পৃষ্ঠপোষক শক্তিগুলো চাইলে সমঝোতার পথ খুলতে পারে। সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারীদের কাছে সুদান একই সঙ্গে সম্পদ ও কূটনৈতিক সাফল্যের সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

ভেনেজুয়েলা-যুক্তরাষ্ট্র

নিজ অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদারের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার উপকূলে সামরিক তৎপরতা বাড়িয়েছে। লক্ষ্য হতে পারে নিকোলাস মাদুরোর শাসনের অবসান ত্বরান্বিত করা, যদিও যুক্তরাষ্ট্র কতদূর যেতে প্রস্তুত তা স্পষ্ট নয়। স্থল আক্রমণের চেয়ে বিমান হামলার আশঙ্কাই বেশি। একই সময়ে ভেনেজুয়েলা প্রতিবেশী গায়ানার তেলসমৃদ্ধ এসেকুইবো অঞ্চলের ওপর শতাব্দীপ্রাচীন দাবি জোরদার করেছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের নির্দেশ অমান্য করে সেখানে প্রশাসনিক নির্বাচনও করেছে। তবে গায়ানার বিরুদ্ধে কোনো সামরিক পদক্ষেপ নিলে তা নিশ্চিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে রূপ নেবে।

সব মিলিয়ে, ২০২৬ সাল বিশ্ব পরিস্থিতির জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল হতে যাচ্ছে। এই সাত সংঘাতের যে কোনো একটি বড় আকার ধারণ করলে তার প্রভাব সীমান্ত ছাড়িয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও কূটনীতিতে গভীর ছাপ ফেলতে পারে।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
কেএএ/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।