করোনা : মানসিক স্বাস্থ্যে গুরুত্ব না দিয়ে মাশুল গুনছে ভারত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:৫১ পিএম, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০

‘আমার হৃদস্পন্দন ভারী হয়ে আসে। নিশ্বাস নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আমার হাত কাঁপে এবং ঘাম ঝরে।’ গত মার্চে করোনাভাইরাস মহামারির বিস্তার ঠেকাতে ভারতে যখন লকডাউন ঘোষণা করা হয়, তখন যে ধরনের আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তার বর্ণনায় এসব কথা বলেন অরিত্রি পল।

ভারত সরকার করোনাভাইরাসের অধিকাংশ কঠোর বিধি-নিষেধ শিথিল করতে শুরু করে গত জুনে। কিন্তু দেশটির নাগরিকদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর লকডাউনের প্রভাবের ক্ষতিকর চিত্র এখন প্রকাশিত হচ্ছে। বিশ্বে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বিরুদ্ধে যেসব দেশ কঠিন লড়াই করছে তার মধ্যে অন্যতম ভারত।

গত কয়েকদিন ধরে দেশটিতে করোনায় রেকর্ড সংক্রমণ শনাক্ত ও মৃত্যু হয়েছে। সোমবার করোনা সংক্রমণে বিশ্বে ব্রাজিলকে টপকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে ভারত। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৪২ লাখ ৮ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত এবং ৭১ হাজার ৭৩৯ জনের প্রাণ হারিয়েছেন করোনায়।

বিশ্বে করোনায় সংক্রমণে শীর্ষে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৬৪ লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত এবং মারা গেছেন এক লাখ ৯৩ হাজারের বেশি।

পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার বাসিন্দা পল বলেন, আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা এবং চোখের ব্যথা হয়। আমার সারা জীবনের তুলনায় এ বছর বেশি প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে।

দেশটিতে আত্মহত্যা প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করে আসা সংস্থা সুইসাইড প্রিভেনশন ইন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন (এসপিআইএফ) গত মে মাসে একটি জরিপ পরিচালনা করে। এই জরিপে দেশটির ১৫৯ জন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অংশ নেন। ৬৫ শতাংশ চিকিৎসক বলেছেন, চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে নিজেই নিজের শরীরের ক্ষতি করছেন; এমন রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।

জরিপে অংশ নেয়া মনোরোগ বিশেষেজ্ঞদের ৮৫ শতাংশ বলেছেন, তাদের অবসাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই অবসাদের কারণে তাদের কাজও ব্যাহত হয়েছে।

গত এপ্রিলে ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রিক স্যোসাইটির অপর এক জরিপে দেখা যায়, এক হাজার ৬৮৫ জন অংশগ্রহণকারীর ৪০ শতাংশ বলেছেন, তারা করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সাধারণ মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি যেমন- বিষণ্নতা এবং হতাশায় ভুগছেন।

বর্তমানে দেশটিতে লকডাউন শিথিল করা হলেও এই পরিস্থিতির কোনও উন্নতি ঘটেনি। জরিপকারীরা গত আগস্টে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, মহামারি কখন শেষ হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং উদ্বেগ এখনও বাড়ছে।

করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার আগেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আত্মহত্যার শীর্ষে ছিল ভারত। দেশটিতে প্রতি একলাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ১৭ জন আত্মহত্যা করছে। এখন দেশটির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন আরও সীমিত হয়ে পড়েছে।

এসপিআইএফের প্রতিষ্ঠাতা নেলসন মোসেস বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর আগে থেকেই অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়েছি। কিন্তু বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে চাহিদা বৃদ্ধি ও সরবরাহ কমে যাওয়ায় এবং সম্মুখ সারির কর্মীদের অবসাদের কারণে আমরা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছি।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনার দীর্ঘ কোনও ইতিহাস ভারতের নেই। ২০১৬ সালে ভারতের ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ সার্ভে দেশটির ১২টি রাজ্যে মানুষের স্বাস্থ্যব্যাধি সম্পর্কে জানতে ৫০টি সূচক তৈরি করে একটি জরিপ পরিচালনা করে।

জরিপে অংশ নেয়া ২৩ বছর বয়সী বলদেব সিং বলেন, সাধারণত জনগণ বিশ্বাস করে যে, মানসিক রোগে আক্রান্তরা অদক্ষ, যুক্তিহীন এবং অবিশ্বস্ত। ফলে তাদের বিয়ের সুযোগও কম। কারও অনুভূতি নিয়ে কথা বললে সেটিকে দুর্বলতা হিসেবে মনে করে মানুষ। এসব নিয়ে প্রচুর ভুল ধারণা রয়েছে।

এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বোঝানোর জন্য দেশটিতে সঠিক শব্দও নেই। ভারতের প্রায় ২২টি ভাষা থাকলেও মানসিক স্বাস্থ্য কিংবা হতাশার মতো শব্দগুলো এর কোনোটিতেই নেই। ফলে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে দেশটিতে নানা ধরনের কুসংস্কার বিদ্যমান আছে।

দেশটিতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে অনেকেই কলঙ্ক হিসেবে মনে করেন। যে কারণে অনেকে এই সমস্যায় ভুগলেও চিকিৎসা নিতে পারেন না। কিন্তু যারা চিকিৎসা নিতে চান, তাদের জন্য চিকিৎসাসুবিধা খুব সীমিত।

২০১৬ সালে ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথের জরিপে দেখা যায়, ভারতে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা প্রায় ৮৩ শতাংশ মানুষের পর্যাপ্ত চিকিৎসাগ্রহণের সুযোগ পান না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, একই বছরে দেশটিতে প্রত্যেক ১০ লাখ মানুষের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন মাত্র তিনজন। এছাড়া মনোবিজ্ঞানীর সংখ্যা আরও কম।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি দশ লাখ মানুষের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আছেন ১০০ জন এবং মনোবিজ্ঞানী প্রায় ৩০০ জন। ১৩০ কোটির বেশি জনসংখ্যার এই দেশটিতে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনা বিশাল চ্যালেঞ্জের। তবে গত কয়েকমাসে পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে শুরু করেছে।

ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্স (নিমহ্যানস) লকডাউনে কর্মস্থলের শহরে আটকে পড়া অভিবাসী শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্য সঙ্কট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয়ভাবে একটি কর্মসূচি হাতে নেয়।

এই কর্মসূচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা ব্যাঙ্গালুরুর চতুর্বেদি। তিনি বলেন, দৃষ্টিভঙ্গিতে যে পরিবর্তন আসছে, এটাই তার প্রমাণ। মানুষও এখন মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে বুঝতে শুরু করেছেন।

গত মার্চে দেশটিতে যখন করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লকডাউন জারি করা হয়, তখন লাখ লাখ অভিবাসী শ্রমিক গ্রামে ফিরতে পারেননি। সেই সময় অনেক শ্রমিক বিভিন্ন এলাকায় সেতুর নিচে ও খোলা আকাশে রাত কাটান।

শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে বাড়িতে পৌঁছে বেশ অনেক শ্রমিক মারাও যান বলে দেশটির গণমাধ্যমে খবর আসে। যদিও পরবর্তীতে করোনায় চাকরি হারিয়ে লকডাউনে আটকা পড়া এসব শ্রমিককে বাড়ি ফেরাতে বিশেষ যানবাহন চালু করে দেশটির সরকার।

এছাড়া শহর ছেড়ে ফিরলেও অনেক শ্রমিককে সেই সময় বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি গ্রামবাসীরা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে গ্রামের বাইরে ঠাই হয় তাদের।

সুইসাইড প্রিভেনশন ইন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা নেলসন মোসেস বলেন, করোনাভাইরাসকে ধন্যবাদ। এখন সবাই হতাশা এবং মনোভঙ্গের একই নৌকার যাত্রী হয়েছে।

করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসায় দেশটির স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং নিমহ্যানস যৌথভাবে একটি হেল্পলাইন স্থাপন করেছে। স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং অভিবাসী শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবিলায় সরকারিভাবে বিভিন্ন ধরনের গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে যাদের মানসিক সমস্যা তৈরি হয়েছে তাদের চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য যোগব্যয়ামসহ বিভিন্ন ধরনের শরীর চর্চা চালিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে পোস্টার তৈরি করে তা এলাকায় প্রচার করা হচ্ছে।

এসআইএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।