কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা

৫৫ বছর পর দেখা মিললো তিন বন্ধুর

পশ্চিমবঙ্গ প্রতিনিধি পশ্চিমবঙ্গ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৩:৫১ পিএম, ২১ জানুয়ারি ২০২৪
ছবি সংগৃহীত

কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় এসে কেউ নতুন প্রেমে পড়েছেন, বইমেলায় এসে হারিয়ে গেছেন এমন দু-একটি ঘটনাও হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু এই বইমেলাও যে হারানো বন্ধুদের ফিরে পাওয়ার নতুন ঠিকানা হতে পারে তা হয়তো অনেকেরই অজানা ছিল। শনিবার দুই বাংলার বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ রচিত হলো আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায়।

আরও পড়ুন: কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় বাংলাদেশ দিবস উদযাপন

তিনজনেরই জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। কলেজে পড়ার সময় গড়ে ওঠে তাদের বন্ধুত্ব। পরে জীবিকার সূত্রে কেউ থেকে যান ভারতে, কেউ পাড়ি দেন বাংলাদেশে। কার্যত তখন থেকেই বন্ধুবিচ্ছেদ! দীর্ঘ প্রায় ৫৫ বছর পর সেই বইমেলাই মিলিয়ে দিলো তিন বন্ধুকে।

jagonews24.com

শনিবার বিকেলে কলকাতা বইমেলা প্রাঙ্গণে নিজেদের মধ্যে দেখা হতেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েন তিন বন্ধু- গৌতম রায়, সফিউদ্দিন আহমেদ এবং দীপক চৌধুরী। চিৎকার করে ছুটে এসে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রাঙ্গণেই দুই বন্ধুকে বুকে টেনে নেন সফিউদ্দিন।

তিন বন্ধুর মধ্যে ফিরে আসলো ৫ দশক আগের বাল্যকালের সেই স্মৃতি। তুই-তুকারি করে একে অপরকে সম্বোধনও করতে দেখা যায়। দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা কথা শেয়ার করেন। এরপর কলকাতার দুই বন্ধুকে বাংলাদেশের টি-শার্ট, টেবিল ক্যালেন্ডার এবং ডায়েরি তুলে দেন সফিউদ্দিন। তাদের এ বিরল মুহূর্তের সাক্ষী ছিলেন কলকাতার বেশকিছু গণমাধ্যমের কর্মীও। সবাই মিলে বেশ কিছুটা সময় কাটালেন বইমেলা প্রাঙ্গণে। পরে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দেখা যায় তিন বন্ধুকে।

১৯৬৪ সালে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন তারা। সেখানেই আলাপ, পরে সেই সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়। এরপর ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত ইংরেজি অনার্সে স্নাতক এবং পরের দুই বছর স্নাতকোত্তর টানা ছয় বছর তিনজনই ছিলেন হরিহর আত্মা। কলেজে থাকাকালীন তিন বন্ধু মিলে বেশ ভালো সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু ১৯৬৯ সালে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দেওয়ার পর থেকেই কার্যত বন্ধুত্বে ছেদ পড়ে।

সফিউদ্দিনের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হাওড়ার মৌড়িগ্রামে। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে কর্মসূত্রে চলে যান বাংলাদেশে। শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেন। তারপর সেখানেই থেকে যান।

অন্যদিকে দীপক চৌধুরী থাকেন হাওড়ার রামরাজাতলায়। ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করতেন। আর কলকাতার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে কাজ করতেন গৌতম রায়। বর্তমানে টালিগঞ্জের বাসিন্দা। যদিও এখন তিন বন্ধুই তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নিয়েছেন। তিনজনেরই বয়স ৭৫ এর কোঠায়।

বইমেলার প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সেই পুরোনো স্মৃতি টেনে সফিউদ্দিন বলেন, আমার মায়ের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে, বাবার বাড়ি বাংলাদেশে। তাই আমার দুই দেশেই সমান অধিকার রয়েছে। ফলে কলকাতা শহর নতুন কিছু নয় শফিউদ্দিনের কাছে। বছরে চারবার এই কলকাতা শহরে এলেও কোনো বারই দেখা মেলেনি বন্ধুদের। তবে একবার উদ্যোগী হয়ে কলেজ বন্ধুর খোঁজে টালিগঞ্জ পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন সফিউদ্দিন। আশেপাশের লোকজনকে জিজ্ঞাসাও করেন কিন্তু খালি হাতে ফিরে আসতে হয় তাকে।

কিন্তু কলকাতা বইমেলাকেই সাক্ষাৎ কেন্দ্র হিসেবে কেন বেছে নিলেন এ প্রশ্নের উত্তরে সফিউদ্দিন জানান, ৪ ফেব্রুয়ারি আমার আসার কথা ছিল। কিন্তু বইমেলা ও বন্ধুদের সাথে দেখার কর্মসূচি থাকায় আজই কলকাতায় চলে আসি।

আগামী ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত কলকাতায় থাকবেন সফিউদ্দিন। ততদিন বন্ধুদের সাথে চুটিয়ে মজা করা, খাওয়া-দাওয়া, দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা এমনকি তিন বন্ধু পুরোনো স্মৃতি ফিরে পেতে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী কফি হাউজেও যাবেন। এ প্রসঙ্গে সফিউদ্দিন বলেন, ১৯৬৪ সালে আমরা ৩৫ পয়সা করে কফি খেয়েছি। সেসময় কফি তৈরির প্রক্রিয়াও ছিল আলাদা ধরনের। ট্রেতে করে গরম পানি, চিনি, দুধ ও কফি আলাদা আলাদা ভাবে আসত। তা থেকে যে দুধটা বেঁচে যেত পরে সেই দুধ তিন বন্ধু মিলে ভাগাভাগি করে খেয়ে ফেলতাম।

সফিউদ্দিনকে কাছে পেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়া গৌতম রায় বলেন, পুরোনো সেই বন্ধুকে ফিরে পাবো এমন আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। বার বার মনে হচ্ছিল বন্ধুদের যদি খুঁজে পাওয়া যেত! আমার একার পক্ষে শফিকে খোঁজা কার্যত অসম্ভব ছিল। এরপরই গত ২৪ ডিসেম্বর আমি হ্যাম রেডিওর সাথে যোগাযোগ করি। তাদের কাছে সফির ৫৫ বছর আগেকার একটি সাদাকালো ছবি ও ডিটেইলস পাঠাই। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অসাধ্য সাধন হয়। বাংলাদেশ থেকে সফির একটা ছবি পাঠানো হয় এবং সেই হাসি দেখেই তাকে চিনতে কোনো অসুবিধাই হয়নি। ভিডিও কলে আমি সফির নাম ধরে চিৎকার করে উঠি, সেও আমার নাম ধরে চিৎকার করে ওঠে।

তবে সফিউদ্দিনের সাথে কলকাতার দুই বন্ধুর মিলনের পেছনে বড় অবদান রয়েছে দুই বাংলার হ্যাম রেডিওর। একথা স্বীকার করে নিয়েছেন তিন বন্ধুই। এমনকি বাংলাদেশের ওই বন্ধুকে ফিরে পেতে এতটাই উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলেন যে এক সময় নিজের সম্পত্তির ভাগও দিতে রাজি হয়েছিলেন গৌতম রায়।

গত ডিসেম্বরেই সফিউদ্দিনের সঙ্গে গৌতম রায়ের যোগাযোগ করিয়ে দেন হ্যাম রেডিওর পশ্চিমবঙ্গ পার্টের সম্পাদক অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস এবং অ্যামেচার রেডিও সোসাইটি অব বাংলাদেশের কার্যকরী সম্পাদক শামসুল হুদা।

মূলত তাদের সৌজন্যেই প্রায় ৫৫ বছর পর স্কটিশের বন্ধু সফিউদ্দিনের খোঁজ পান গৌতম-দীপকরা। এরপরেই তিন বন্ধু মুখোমুখি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আসলে যে সুতো ছিঁড়ে গিয়েছিল কালের স্রোতে, সেটাই আবার জুড়ল শনিবার। কলেজের বন্ধু গৌতম ও দীপকের সঙ্গে দেখা করতেই বাংলাদেশ থেকে কলকাতা বইমেলায় আসেন সফিউদ্দিন। জমিয়ে আড্ডা দিলেন স্কটিশের সেই তিনমূর্তি।

অম্বরিশ জানান, চেষ্টা করলেই সফলতা আসে। গৌতম নামে একজন প্রবীন নাগরিক আমাকে ফোন করে বললেন তার বন্ধুকে ফিরে পেতে গাঁটের পয়সা খরচ করতেও রাজি। এরপরে এসে বন্ধুকে খুঁজে পেতে অ্যামেচার রেডিও অব বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এরপরে সফলও হই। তার অভিমত মেলা মানেই মিলন। হ্যাম রেডিওর পক্ষ থেকে আমরা খুবই গর্বিত যে সেই মেলায় ৫৫ বছর পর বন্ধুদের আবারও দেখা হলো। এটা একটা ইতিহাস।

jagonews24.com

অন্যদিকে শামসুল হুদা বলেন, আমি যখন জানতে পারলাম যে তিন বন্ধু বইমেলাতে মিলিত হচ্ছেন, তখন আমিও ঠিক করলাম ওই সন্দীক্ষণে আমাকেও থাকতে হবে। আমাকে ওই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে হবে। আর তাই ঢাকা থেকে আমিও কলকাতায় চলে আসি। তিনি আরও বলেন, গৌতম বাবুর মোবাইল টেক্সটে একটি লাইন ছিল তা হলো জীবনের শেষ বেলা আমি আমার বন্ধুকে দেখতে চাই। ওই টেক্সট পাওয়ার তিন ঘন্টার মধ্যে আমি তার বন্ধু সফিউদ্দিনকে খুঁজে বের করেছি।

আরও পড়ুন: স্ত্রী অসুস্থ, প্রবেশপত্রের ছবি বদলে পরীক্ষায় বসলেন স্বামী

বৃহস্পতিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর হাত ধরে উদ্বোধন হয় কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার। মেলা চলবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। মেলার দ্বার খোলা থাকবে প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। ভিড় ও উন্মাদনায় এ যেন বাঙালির দ্বিতীয় দুর্গোৎসব। সেই সাথে উৎসব ছিল থ্রি ইডিয়টসেরও। হবে নাই বা কেন? এদিন চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই নিজেদেরকে থ্রি ইডিয়টস বলে সম্বোধন করেন গৌতম রায় নিজেই।

ডিডি/টিটিএন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।