মাজার স্থানান্তরের আবেদনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০২:১৮ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
সুপ্রিম কোর্টের প্রাঙ্গণে বহুতল মসজিদ নির্মাণের কাজ চলছে, ছবি: জাগো নিউজ

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে সম্প্রতি নুরাল পাগলার মাজারে হামলার পাশাপাশি সেখান থেকে তার মরদেহ তুলে পোড়ানোর মতো ঘটনা ঘটে। এটিসহ গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কমপক্ষে দেড় শতাধিক মাজার-খানকায় হামলার খবর সামনে আসে। এসব হামলার ঘটনা সামনে এনে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণ থেকে মাজার স্থানান্তরের আবেদনের পর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

এদিকে মাজার রক্ষায় পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট। তারা সুপ্রিম কোর্টের মাজার গেটের বাইরে মিছিলও করেছে। প্রয়োজনে মাজার প্রাঙ্গণ থেকে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট ও ট্রাইব্যুনাল সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিও দিয়েছেন।

সুপ্রিম কোর্ট মাজার মসজিদ/ফাইল ছবিসুপ্রিম কোর্ট মাজার মসজিদ/ফাইল ছবি

সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণ থেকে মাজার সরিয়ে নেওয়া বা না নেওয়া নিয়ে মাজার কমিটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবু বকর জাগো নিউজকে বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অঙ্গন থেকে মাজার সরিয়ে নেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। আবার শুনেছি, পাল্টা একটি চিঠিও দেওয়া হয়েছে মাজার সরিয়ে না নেওয়ার জন্য। আসলে আমরা এখনো চিঠির কোনো তথ্যই পাইনি। মাজার কমিটিও আমাদের কোনো কিছু জানায়নি।’

মাজার সরিয়ে নেওয়া-না নেওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় সূত্র জাগো নিউজকে জানায়, মাজার সরিয়ে নেওয়া-না নেওয়ার বিষয়ে এখনো কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত বা আলোচনা হয়নি। এ বিষয়ে বর্তমান মাজার কমিটি এবং সুপ্রিম কোর্টের জমি-জমা দেখভাল করার জন্য যে সংক্রান্ত কমিটি রয়েছে তারাও এটা নিয়ে কোনো আলোচনা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি।

আরও পড়ুন
সুপ্রিম কোর্ট ও ট্রাইব্যুনাল থেকে মাজার স্থানান্তরের আবেদন
১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সুপ্রিম কোর্টে হবে মসজিদ
গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সভা-সমাবেশে ডিএমপির নিষেধাজ্ঞা

মাজার স্থানান্তর ও বহুতল মসজিদ নির্মাণ পুনর্বিবেচনার আবেদন

গত ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রাঙ্গণ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রাঙ্গণ থেকে মাজার স্থানান্তর ও বহুতল মসজিদ নির্মাণ পুনর্বিবেচনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ে আবেদন করা হয়। আবেদনকারী মো. মাহমুদুল হাসান সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য।

আবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয়, দেশের সংবিধান অনুযায়ী নাগরিক দায়িত্ব ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে এই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

তিনি উল্লেখ করেন, সুপ্রিম কোর্ট ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে অবস্থিত মাজার এবং মাজার মসজিদটি বর্তমানে ভেঙে বহুতল মসজিদ নির্মাণের কাজ চলছে। মাজার থাকার কারণে প্রাঙ্গণে নিয়মিত ভবঘুরে লোকজন, ভিক্ষুক এবং মাজার ভক্তদের উপস্থিতি থাকে। বৈশ্বিকভাবে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি না থাকায় এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত ও পাকিস্তানে মাঝেমধ্যে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটায় হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে মাজার থাকার কারণে ছদ্মবেশে দেশি-বিদেশি সন্ত্রাসী ও গোয়েন্দাদের অবস্থান ও নজরদারির সম্ভাবনা রয়েছে। এতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি, আইনজীবী, কোর্ট স্টাফ এবং বিচারপ্রার্থী জনগণের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।

আবেদনকারীর যুক্তি অনুযায়ী, ‘মাজার যথাযথ ধর্মীয় মর্যাদায় স্থানান্তর করে অন্য কোনো উপযুক্ত স্থানে প্রতিস্থাপন করা উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কবর স্থানান্তরের উদাহরণ রয়েছে, যা নতুন কোনো বিষয় নয়। ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে মাজার স্থানান্তর সম্ভব।

অবশ্যই সুপ্রিম কোর্ট ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রাঙ্গণে মসজিদ নির্মাণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত। সুপ্রিম কোর্ট ও বার অ্যাসোসিয়েশন প্রাঙ্গণে কয়েকটি মসজিদ আছে, যা মোটামুটি পর্যাপ্ত। নতুন বহুতল মসজিদ নির্মাণ করলে নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হবে।’

আরও পড়ুন
রাজবাড়ীতে কবর থেকে তুলে মরদেহে আগুন
সাম্প্রদায়িক সহিংসতার উচ্চ ঝুঁকিতে ৫ জেলা
রাজশাহীতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো মাইজভান্ডারি অনুসারীর খানকা

আবেদনে বলা হয়, যদি বহুতল মসজিদ নির্মাণ করা বাধ্যতামূলক হয় তবে বিদ্যমান সড়ক ভবনের মসজিদ ভেঙে বহুতল মসজিদ নির্মাণের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে মাজার স্থানান্তর এবং বহুতল মসজিদ নির্মাণের সম্ভাব্য নিরাপত্তা ঝুঁকি সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা আবশ্যক।

আবেদনকারীর অনুরোধ, সুপ্রিম কোর্ট ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রাঙ্গণ থেকে মাজার স্থানান্তর করা হোক এবং বহুতল মসজিদ নির্মাণ পুনর্বিবেচনার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। যাতে বিচারপতি, আইনজীবী, কোর্ট স্টাফ এবং বিচারপ্রার্থী জনগণের জীবন সুরক্ষিত থাকে।

বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের বিবৃতি

সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণ থেকে মাজার স্থানান্তর ও বহুতল মসজিদ নির্মাণ পুনর্বিবেচনার জন্য আইনজীবীর আবেদনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট। তারা প্রয়োজনে মাজার প্রাঙ্গণ থেকে সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট ও ট্রাইব্যুনাল সরানোর আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের চেয়ারম্যান এম এ মতিন ও মহাসচিব অধ্যক্ষ আল্লামা স. উ. ম আবদুস সামাদ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, নিরাপত্তার অজুহাতে হাইকোর্ট মাজার শরিফ ও মসজিদ সরানোর আবেদন করা সরাসরি ইসলাম অবমাননার শামিল। বাংলার জনগণ কখনো তা মেনে নেবে না, দেশবাসী এ ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র প্রতিহত করবে। নিরাপত্তার প্রয়োজনে মাজার প্রাঙ্গণ থেকে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট অন্যত্র সরিয়ে নিন।

মাজার স্থানান্তরের আবেদনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন

আজকের ঢাকা প্রতিষ্ঠার আগে এই মাজার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার ৬০৭ বছর আগে হযরত শাহ্ খাজা শরফুদ্দিন চিশতীর মাজার প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি ৭৩৮ হিজরি মোতাবেক ১৩৪০ ইংরেজি ওফাত লাভ করেন, আর ঢাকা হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৭ সালে। হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার পর থেকে হাইকোর্ট মাজার হিসেবে খ্যাত হয়। ভুলে গেলে চলবে না যে, এ দেশে পবিত্র ইসলাম ধর্ম এসেছে পীর-আউলিয়াদের মাধ্যমে। বর্তমানে সেই ইসলাম প্রচারক পীর আউলিয়াদের মাজার ধ্বংসের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে উগ্রবাদী ধর্মান্ধ সন্ত্রাসী চক্র।

এতে আরও বলা হয়, আমরা তাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলতে চাই আল্লাহর অলিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এ বাংলায় কখনো শান্তি স্থাপিত হবে না। ২৪’র গণআন্দোলন পরবর্তী ১০০টির বেশি মাজার-খানকায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হামলা হয়েছে। এতদিন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সুফিবাদী ও অহিংস হওয়ার কারণে এসব মব-সন্ত্রাস ও সহিংসতা করে পার পেয়েছে। সুন্নিদের ধৈর্যের আর পরীক্ষা নেবেন না। সুন্নি জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে বারবার আঘাত করলে সু্ন্নিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়তে শুরু করলে সন্ত্রাসীরা কোনো ছাড় পাবে না।

এফএইচ/এমআইএইচএস/এমএমএআ/এমএফএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।