আপনার ডিপ্রেশন থাকলে শীতকালে সাবধান হবেন যে কারণে
শীত এলেই অনেকের মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে আসে। সকালে ঘুম ভাঙতে চায় না, কাজে মন বসে না, কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না — এই অনুভূতিগুলোকে আমরা প্রায়ই শীতের অলসতা বলে এড়িয়ে যাই।
কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, শীতকালে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা বাড়ার পেছনে স্পষ্ট জৈবিক ও মানসিক কারণ আছে। এটি কেবল মনের ব্যাপার নয়; শরীর, আলো, ঘুম, হরমোন — সব মিলিয়েই এই পরিবর্তন ঘটে।
আলো কমে গেলে মন খারাপ লাগে কেন
শীতকালে দিনের আলো স্বাভাবিকভাবেই কমে যায়। সূর্যালোক কম পাওয়ার ফলে মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামের নিউরোট্রান্সমিটার কম নিঃসৃত হয়। সেরোটোনিন আমাদের ভালো লাগা, শান্ত থাকা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আলো কম মানেই সেরোটোনিন কম, আর তার সরাসরি প্রভাব পড়ে মুডে। এ কারণেই অনেক মানুষ শীতে অকারণ মন খারাপ, হতাশা বা আগ্রহহীনতায় ভোগেন।
মেলাটোনিনের বাড়াবাড়ি
শীতকালে রাত বড় হয়, দিন ছোট হয়। এতে শরীরে মেলাটোনিন হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। এই হরমোন আমাদের ঘুম পাড়াতে সাহায্য করে। কিন্তু যখন মেলাটোনিন বেশি হয়, তখন সারাদিন ঝিমুনি, ক্লান্তি ও এনার্জির ঘাটতি দেখা দেয়। দীর্ঘদিন এভাবে চললে মন ধীরে ধীরে বিষণ্নতার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডার কী
চিকিৎসাবিজ্ঞানে শীতকালীন ডিপ্রেশনকে বলা হয় সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডার বা এসএডি। এটি মূলত একটি মৌসুমি বিষণ্নতা, যা সাধারণত শরৎ শেষ থেকে শীতজুড়ে বাড়ে এবং বসন্ত এলে অনেকের ক্ষেত্রে কমে যায়। এসএডি-তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা বেশি ঘুমান, মিষ্টি বা কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবারের প্রতি ঝোঁক বাড়ে, ওজন বাড়তে পারে এবং সামাজিক আগ্রহ কমে যায়।

শীতের জীবনযাপনও দায়ী
শীতকালে আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাস বদলে যায়। বাইরে হাঁটাহাঁটি কমে, শরীরচর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, রোদে বসার সুযোগও কম থাকে। ঘরের ভেতরে বেশি সময় কাটানো, স্ক্রিন টাইম বেড়ে যাওয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ কমে যাওয়াও ডিপ্রেশনের ঝুঁকি বাড়ায়। শরীর নড়াচড়া না করলে মস্তিষ্কে এন্ডোরফিন বা ‘ফিল গুড’ হরমোন কম নিঃসৃত হয়।
খাবার ও মনের সম্পর্ক
শীতে অনেকেই বেশি ভাজাপোড়া ও মিষ্টি খাবারের দিকে ঝুঁকেন। সাময়িকভাবে এগুলো ভালো লাগার অনুভূতি দিলেও দীর্ঘমেয়াদে রক্তে শর্করার ওঠানামা বাড়ায়, যা মুড সুইং ও ক্লান্তির কারণ হতে পারে। গবেষণায় বারবার উঠে এসেছে - পর্যাপ্ত প্রোটিন, ভিটামিন ডি ও ওমেগা-থ্রি না পেলে ডিপ্রেশনের ঝুঁকি আরও বাড়ে।

কারা বেশি ঝুঁকিতে
যাদের আগে থেকেই ডিপ্রেশন বা অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারের ইতিহাস আছে, তারা শীতে বেশি ভোগেন। একইভাবে একা থাকা মানুষ, কর্মহীনতা বা আর্থিক চাপের মধ্যে থাকা ব্যক্তি এবং যারা দিনের আলো খুব কম পান—তাদের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। নারীদের ক্ষেত্রে হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে শীতকালীন বিষণ্নতা বেশি দেখা যেতে পারে।
কী করলে শীতে মন ভালো রাখা যায়
শীতকালীন ডিপ্রেশন পুরোপুরি এড়ানো সব সময় সম্ভব না হলেও, কিছু অভ্যাস ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। প্রতিদিন সকালে অন্তত কিছু সময় রোদে বসার চেষ্টা করুন। হালকা হাঁটা বা ঘরে ব্যায়াম করুন, যাতে শরীর সচল থাকে। ঘুমের সময় নির্দিষ্ট রাখুন, কারণ অতিরিক্ত ঘুমও ক্ষতিকর। খাবারে ভিটামিন ডি, ফল, শাকসবজি ও প্রোটিন রাখুন। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ — মন খারাপ দীর্ঘদিন থাকলে সেটিকে দুর্বলতা ভাববেন না; প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলরের সঙ্গে কথা বলুন।
শীতকালে ডিপ্রেশন বাড়া কোনো কল্পনা নয়, এটি বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবতা। আলো কমে যাওয়া, হরমোনের পরিবর্তন ও জীবনযাপনের ধীরগতিই এই সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে। সময়মতো বিষয়টি বুঝে যত্ন নিলে শীতকালও হতে পারে আরামদায়ক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার সময়।
সূত্র: আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ, জার্নাল অফ অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডারস
এএমপি/জেআইএম