ফ্যাটি লিভার সম্পর্কে যা জানা জরুরি

জান্নাত শ্রাবণী
জান্নাত শ্রাবণী জান্নাত শ্রাবণী , সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ০১:৫৩ পিএম, ০৭ অক্টোবর ২০২৫
ফ্যাটি লিভারের ফলে ব্যথায় কাতরাচ্ছেন এক নারী, প্রতীকী ছবি

বর্তমানে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সংবাদে যে রোগটির নাম প্রায়ই উঠে আসছে, তা হলো ফ্যাটি লিভার ডিজিজ বা চর্বিযুক্ত লিভার। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর বৈজ্ঞানিক নাম নন-অ্যালকোহলিক হেপাটিক স্টিয়াটোসিস। নামের মধ্যেই এর অবস্থান স্পষ্ট-এই রোগ মূলত লিভার বা যকৃতকে আক্রান্ত করে। আশঙ্কার বিষয় হলো, দিন দিন এ রোগের প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে এটি মারাত্মক জটিলতায় রূপ নিতে পারে।

মদপান না করলেও হতে পারে ফ্যাটি লিভার

অনেকেই মনে করেন, লিভারের সমস্যা মানেই মদপান। কিন্তু ফ্যাটি লিভার রোগের ক্ষেত্রে বিষয়টি পুরোপুরি ঠিক নয়। নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ এমন এক ধরনের লিভার রোগ, যা এমন লোকেরও হতে পারে যারা জীবনে কখনো মদপানই করেননি। অর্থাৎ মদ না খেলেও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। তবে এটা সত্য যে, অতিরিক্ত মদপান লিভারের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এবং দীর্ঘমেয়াদে লিভার সিরোসিসসহ নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

কেন হয় ফ্যাটি লিভার

লিভারে অতিরিক্ত চর্বি জমে গেলে ফ্যাটি লিভার তৈরি হয়। সাধারণত, যদি লিভারের মোট ওজনের ৫ থেকে ১০ ভাগ চর্বি দিয়ে তৈরি হয়, তখন সেটিকে ফ্যাটি লিভার বলা হয়। এই অতিরিক্ত চর্বি লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোষ নষ্ট হতে থাকে। চিকিৎসা না করলে লিভার স্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়ে।

আরও পড়ুন
গর্ভধারণের আগে ফলিক অ্যাসিড, চিকিৎসক ‍কী বলছেন
ডিম্বাশয়ের সিস্ট মানেই সন্তানধারণে অক্ষমতা নয়

বিপজ্জনক হারে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা

২০১৯ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কানাডায় প্রায় ৭০ লাখ মানুষ নন-অ্যালকোহলিক হেপাটিক স্টিয়াটোসিসে আক্রান্ত ছিলেন, যা দেশটির সবচেয়ে সাধারণ লিভার রোগ হিসেবে চিহ্নিত। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায়, ৪৬ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো না কোনো মাত্রায় এই রোগের উপস্থিতি রয়েছে।

ফ্যাটি লিভার সম্পর্কে যা জানা জরুরি

শুধু প্রাপ্তবয়স্করাই নন, শিশু ও কিশোরদের মধ্যেও এ রোগ দ্রুত ছড়াচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৫ শতাংমেরও বেশি এখন ফ্যাটি লিভার রোগে আক্রান্ত, যা গত ৩০ বছরে ৫০ শতঅংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি দুই বছর বয়সী শিশুদের মধ্যেও এ রোগের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

কারা বেশি ঝুঁকিতে

পুরুষদের তুলনায় প্রজননক্ষম বয়সের নারীরা তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিতে থাকেন। তবে মেনোপজের পর নারীদের ঝুঁকি পুরুষদের সমান হয়ে যায়।

অন্যদিকে টাইপ-২ ডায়াবেটিস ফ্যাটি লিভারের অন্যতম বড় ঝুঁকি। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেক ডায়াবেটিস রোগীর লিভারে চর্বি জমে এবং অনেকের ক্ষেত্রেই তা গুরুতর আকারে দেখা দেয়।

স্থূলতা ও অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস

স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন ফ্যাটি লিভারের সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোটা ব্যক্তিদের প্রায় ৬৬ শতাংশ নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রায় ১৪ শতাংশ মানুষের রোগটি গুরুতর পর্যায়ে পৌঁছায়, অর্থাৎ নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিস বা লিভার ফাইব্রোসিসে রূপ নেয়।

চিকিৎসা না করালে, ৫ থেকে ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে সাধারণ ফ্যাটি লিভার ধীরে ধীরে নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিসে (এনএএসএইচ) পরিণত হয়। এই পর্যায়ে লিভারে স্থায়ী প্রদাহ ও ক্ষত সৃষ্টি হয়, যা মদপানের কারণে হওয়া ক্ষতির সমান বিপজ্জনক।

সিরোসিস থেকে ক্যানসার

নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিস রোগীদের মধ্যে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পরবর্তীতে লিভার ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত হন, যা লিভারে অতিরিক্ত দাগ বা স্কার টিস্যু তৈরি করে। ফলস্বরূপ অনেক সময় রোগটি লিভার সিরোসিসে পরিণত হয়, যেখানে লিভারের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এই পর্যায়ে রোগী জন্ডিস, পেট ফুলে যাওয়া, মানসিক বিভ্রান্তি বা কোমায় পর্যন্ত যেতে পারে।

সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো, লিভার সিরোসিসের পরবর্তী ধাপ হতে পারে লিভার ক্যানসার, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রাণঘাতী। কানাডায় অন্তত ৯০ হাজার মানুষ ফ্যাটি লিভারের কারণে ক্যানসারের ঝুঁকিতে আছেন এবং ভবিষ্যতে এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অন্যান্য ঝুঁকি

যাদের রক্তে চর্বি বা লিপিডের মাত্রা অস্বাভাবিক, যেমন উচ্চ কোলেস্টেরল, উচ্চ ট্রাইগ্লিসারাইড বা ডিসলিপিডেমিয়া, তাদের ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষদের ক্ষেত্রে ফ্যাটি লিভার মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায় হৃদরোগের, আর নারীদের ক্ষেত্রে এটি বাড়ায় ক্যানসারের ঝুঁকি।

ফ্যাটি লিভার সম্পর্কে যা জানা জরুরি

লিভারের কার্যক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা

ফ্যাটি লিভার দীর্ঘদিন অবহেলায় থাকলে ক্রনিক লিভার ফেলিওর হতে পারে। এতে লিভার তার স্বাভাবিক কাজ, যেমন- দেহের বিষাক্ত পদার্থ নির্মূল, প্রোটিন তৈরি ও পুষ্টি সঞ্চয় করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় অনেক সময় লিভার ট্রান্সপ্লান্ট বা প্রতিস্থাপন ছাড়া উপায় থাকে না।

আরও পড়ুন
আক্কেল দাঁত: মুখের ছোট অতিথি, বড় ঝামেলা
মাদকাসক্তি শুধু খারাপ অভ্যাস নয়, এটি মানসিক রোগ

চিকিৎসা ও প্রতিরোধ

বর্তমানে ফ্যাটি লিভার রোগের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। যদিও কিছু ওষুধ, যেমন-পেগবেলফারমিন পরীক্ষাধীন, তবে এখন পর্যন্ত কার্যকর চিকিৎসা অনুমোদিত হয়নি। তবে আশার কথা হলো, ওজন কমালে অনেক ক্ষেত্রে ফ্যাটি লিভার সম্পূর্ণ সেরে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা তাদের মোট ওজনের ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমাতে সক্ষম হয়েছেন, তাদের লিভারে জমে থাকা অতিরিক্ত চর্বি প্রায় সম্পূর্ণভাবে দূর হয়েছে।

চিকিৎসকরা যা পরামর্শ দেন

>> ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে
>> নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা হাঁটা-দৌড়ের অভ্যাস করতে হবে (সপ্তাহে অন্তত চারদিন)
>> চিনি, কোমলপানীয়, ভাজাপোড়া ও প্রক্রিয়াজাত খাবার এড়িয়ে চলা জরুরি
>> পরিবর্তে ফল, শাক-সবজি, পূর্ণ শস্য, আঁশযুক্ত খাবার ও স্বাস্থ্যকর চর্বি খাওয়া উচিত
>> প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া ভালো

এক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত হাঁটা ও হালকা দৌড় ফ্যাটি লিভার প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।

  • রোগ শনাক্তকরণ

চিকিৎসক সাধারণত রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ফ্যাটি লিভারের প্রাথমিক ধারণা পান। যদি অ্যাসপারটেট অ্যামিনোট্রান্সফারেজ (এএসটি) ও অ্যালানিন অ্যামিনোট্রান্সফারেজ (এএলটি) এনজাইমের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ৪ গুণ বেশি হয়, তাহলে আল্ট্রাসনোগ্রাম বা লিভার বায়োপসি করে নিশ্চিত করা হয়। অনেক সময় রুটিন রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেও রোগটি অজান্তে ধরা পড়ে।

ফ্যাটি লিভার বর্তমানে এক নীরব ঘাতক রোগে পরিণত হচ্ছে। এটি শুরুতে কোনো উপসর্গ ছাড়াই দেহে বাসা বাঁধে, কিন্তু অবহেলা করলে ধীরে ধীরে লিভার ক্যানসার পর্যন্ত গড়াতে পারে। তাই অল্প বয়স থেকেই স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, সুষম খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মিত ব্যায়াম অভ্যাসে পরিণত করাই হতে পারে এই রোগ থেকে রক্ষার সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

তথ্যসূত্র: এমএসএন

জেএস/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।