মেয়েদের বয়স, ছেলেদের ক্যারিয়ার এই বৈষম্য কেন?

লাইফস্টাইল ডেস্ক
লাইফস্টাইল ডেস্ক লাইফস্টাইল ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৮:৩৯ এএম, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত

বিয়ের আলোচনায় সমাজের নীরব পক্ষপাত। একই পরিবারে, একই বৈঠকে, একই প্রশ্ন; কিন্তু প্রশ্নের ধরন আলাদা। মেয়ের জন্য প্রশ্ন বয়স কত হলো? আর ছেলের জন্য প্রশ্ন ক্যারিয়ার কেমন চলছে? এই দুই প্রশ্নের মাঝখানেই লুকিয়ে আছে আমাদের সমাজের দীর্ঘদিনের এক গভীর বৈষম্য। বিয়ে নিয়ে আলোচনা শুরু হলেই যেন মেয়েদের জীবনের সময় গণনা শুরু হয় আর ছেলেদের জীবনের সক্ষমতা বিচার করা হয়। এই বৈষম্য হঠাৎ তৈরি হয়নি। এটি সামাজিকভাবে লালিত, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহন করা এক মানসিক কাঠামো।

‘বয়স’ মেয়েদের জন্য সময়সীমা কেন?

‘বয়স’ মেয়েদের জন্য সময়সীমা কেন?

মেয়েদের বয়সকে বিয়ের ক্ষেত্রে প্রধান মানদণ্ড বানানোর পেছনে কয়েকটি পুরোনো বিশ্বাস কাজ করে-

প্রথমত, জৈবিক ভয়। সমাজে এখনও একটি ধারণা প্রচলিত বয়স বাড়লে মেয়েরা মা হতে পারবে না, সংসার সামলাতে পারবে না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতি, স্বাস্থ্যসচেতনতা এসব বাস্তবতা উপেক্ষা করে মেয়েদের জীবনে একটি অদৃশ্য সময়সীমা টেনে দেওয়া হয়।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক মর্যাদা। ‘বয়স হয়ে গেছে’ এই বাক্যটি কেবল সময়ের হিসাব নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক চাপ। যেন নির্দিষ্ট বয়সের পর অবিবাহিত থাকা মেয়েদের জন্য লজ্জার বিষয়।

তৃতীয়ত, পছন্দের সংকোচন। বয়স বাড়লে মেয়েদের জন্য পাত্রের তালিকা ছোট হতে থাকে, এই ভয়ও পরিবারগুলোকে তাড়িত করে। ফলে মেয়েদের বয়স শুধু একটি সংখ্যা থাকে না; এটি হয়ে ওঠে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অস্ত্র।

‘বয়স’ মেয়েদের জন্য সময়সীমা কেন?

অন্যদিকে ছেলেদের ক্ষেত্রে বয়স নয়, প্রশ্ন আসে ক্যারিয়ার নিয়ে। কারণ সমাজ এখনো ছেলেদের দেখে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে। ছেলেদের বলা হয় আগে নিজের পায়ে দাঁড়াও, ক্যারিয়ার সেট করো, আয় বাড়ুক, তারপর বিয়ে। এই বক্তব্যগুলো শুনতে ইতিবাচক মনে হলেও এর ভেতরেও আছে চাপ। তবে এই চাপের প্রকৃতি আলাদা। এখানে সময়ের বদলে গুরুত্ব পায় সক্ষমতা। ছেলেদের বয়স বাড়লেও বলা হয়-সময় আছে, আরও একটু দাঁড়াক। এই সময়টা মেয়েদের ক্ষেত্রে সমাজ দেয় না।

একজন ৩০ বছর বয়সী মেয়ে অবিবাহিত হলে তাকে বলা হয় ‘আর কতদিন?’, ‘এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে’। অন্যদিকে একজন ৩০ বছর বয়সী ছেলে অবিবাহিত হলে বলা হয় ‘ভালো, ক্যারিয়ার গড়ছে’, ‘এখন বিয়ে করলে মন বসবে না’। একই বয়স, একই বাস্তবতা; কিন্তু সামাজিক ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এই বৈষম্যের শিকড় কোথায়?

পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো: আমাদের সমাজে পুরুষকে উপার্জনকারী, নারীকে গৃহস্থালির কেন্দ্র হিসেবে দেখা হয়। ফলে নারীর জীবনে সময়কে গুরুত্বপূর্ণ আর পুরুষের জীবনে সক্ষমতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।

নারীর জীবনকে সীমাবদ্ধ করে দেখার অভ্যাস: মেয়েদের জীবনকে অনেক সময় বিয়ে ও মাতৃত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেখা হয়। তাই বয়স বাড়া মানে যেন সুযোগ কমে যাওয়া।

সামাজিক তুলনার সংস্কৃতি: ‘অমুকের মেয়ের তো বিয়ে হয়ে গেছে’-এই তুলনা মেয়েদের ওপর চাপ বাড়ায়। ছেলেদের ক্ষেত্রে এমন তুলনা তুলনামূলক কম।

আরও পড়ুন: 

 

এই বয়স-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি মেয়েদের জীবনে বড় প্রভাব ফেলে। অনেকেই ক্যারিয়ার থামিয়ে দেয়, নিজের পছন্দের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে, শুধু সমাজের চাপ মেটাতে বিয়ে করে। ফলে বিয়ে একটি আনন্দের সিদ্ধান্ত না হয়ে অনেকের জন্য হয়ে ওঠে চাপ থেকে মুক্তির পথ।

তাহলে ছেলেরা কি চাপমুক্ত? এই আলোচনায় ছেলেদের চাপও অস্বীকার করা যায় না। ক্যারিয়ার নিয়ে নিরন্তর চাপ, আর্থিক স্থিতি গড়ার দৌড় সব মিলিয়ে অনেক ছেলেই মানসিক ক্লান্তিতে ভোগে।

তবে পার্থক্য এখানেই ছেলেদের চাপ গড়ার, মেয়েদের চাপ ছাড়ার। ছেলেদের বলা হয় এগোতে, মেয়েদের বলা হয় তাড়াতাড়ি থামতে।

বদলাচ্ছে কি চিত্র?

শহুরে শিক্ষিত সমাজে ধীরে ধীরে এই মানসিকতায় পরিবর্তন আসছে। অনেক পরিবার এখন মেয়েদের ক্যারিয়ার, মানসিক প্রস্তুতি আর ব্যক্তিগত পছন্দকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আবার অনেক তরুণ-তরুণী বিয়েকে জীবনের একমাত্র সাফল্য হিসেবে দেখছে না। তবু এই পরিবর্তন এখনও সীমিত। বৃহৎ সামাজিক কাঠামো এখনো পুরোনো প্রশ্নই করে যায় ‘মেয়েদের বয়স কত, ছেলেদের আয় কত’।

সমাধান কোথায়? সমাধান একদিনে আসবে না। তবে কিছু প্রশ্ন নতুন করে ভাবা জরুরি-

  • বিয়ে কি সময়ের দৌড়?
  • মেয়েদের জীবন কি শুধু বয়সের ওপর নির্ভরশীল?
  • ছেলেদের মূল্য কি কেবল আয়ে সীমাবদ্ধ?

এই প্রশ্নগুলো পরিবারে, সমাজে, নিজেদের ভেতরে তোলা না গেলে বৈষম্য কাটবে না।

‘বয়স’ মেয়েদের জন্য সময়সীমা কেন?

বিয়ে কোনো প্রতিযোগিতা নয়, কোনো সময়সীমার পরীক্ষা নয়। এটি হওয়া উচিত দুজন মানুষের প্রস্তুতি, সম্মতি ও স্বস্তির জায়গা। যেদিন আমরা মেয়েদের বয়স নয়, তাদের মানুষ হিসেবে দেখব; আর ছেলেদের ক্যারিয়ার নয়, তাদের মানসিক প্রস্তুতিকে গুরুত্ব দেব সেদিন হয়তো এই প্রশ্নটাও আর করতে হবে না ‘মেয়েদের বয়স, ছেলেদের ক্যারিয়ার এই বৈষম্য কেন?’

জেএস/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।