চোরাই পণ্যে রমরমা রিয়াজউদ্দিন বাজার, রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
চট্টগ্রাম নগরীর বাসিন্দাদের কেনাকাটার জন্য অন্যতম নির্ভরতার স্থান রিয়াজউদ্দিন বাজার। ঐতিহ্যবাহী এ বাজারটি দেড়শ বছরের পুরোনো। এই বাজারে শাক-সবজি থেকে শুরু করে লাখ টাকা দামের মোবাইল ফোনও মেলে। খুচরার পাশাপাশি চলে পাইকারি বেচাকেনা। বিভিন্ন পণ্যের দামও তুলনামূলক কিছুটা কম।
তবে মোবাইল ফোন, সিগারেট ও প্রসাধন সামগ্রীসহ বিভিন্ন পণ্যের ব্যবসা ঘিরে এ বাজারে গড়ে উঠেছে বড়োসড়ো চোরাকারবারি চক্র। বাজারটির সুবিধা ও সীমাবদ্ধতার নানান দিক নিয়ে চার পর্বের ধারাবাহিকের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র রিয়াজউদ্দিন বাজার। এ বাজার ঘিরে চলে বৈধ-অবৈধ বিভিন্ন ব্যবসা। বিভিন্ন সময় রাতবিরাতে বাজারটি হয়ে ওঠে অবৈধ ব্যবসার অভয়ারণ্য। রিয়াজউদ্দিন বাজারে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ে চোরাই মোবাইল ফোন, বিদেশি সিগারেট ও প্রসাধন পণ্যের অবৈধ বেচাকেনা।
বর্তমানে রিয়াজউদ্দিন বাজার বিদেশি সিগারেট ও প্রসাধন সামগ্রীর আড়তে পরিণত হয়েছে। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি করা এসব পণ্য প্রতিদিন ভোরে বাজারে ঢুকছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পাইকারি ও খুচরায় হচ্ছে বিক্রি।
রিয়াজউদ্দিন বাজার বিদেশি সিগারেট ও প্রসাধন সামগ্রীর আড়তে পরিণত হয়েছে। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আমদানি করা এসব পণ্য প্রতিদিন ভোরে বাজারে ঢুকছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পাইকারি ও খুচরায় চলছে বিক্রি
সরেজমিনে বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন দোকানে নামিদামি বিদেশি ব্র্যান্ডের সিগারেট ও প্রসাধনী। কিন্তু বেশিরভাগ পণ্যের কোনো বৈধ আমদানি কাগজপত্র নেই। ফলে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। বিপরীতে অসাধু ব্যবসায়ীরা বনে যাচ্ছেন কোটিপতি।
অভিযোগ আছে, এসব ব্যবসার ক্ষেত্রে টাকার ভাগ যাচ্ছে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তার পকেটেও। মাঝেমধ্যে ‘লোক দেখানো’ অভিযান পরিচালনা হলেও নেই কোনো স্থায়ী পরিকল্পনা। ফলে সৎ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বাজারের ব্যবসায়ীরা।
সাম্প্রতিক সময়ে এসব পণ্য জব্দ ও অভিযানের কয়েকটি বড় ঘটনায় দেখা যায়, পণ্যগুলো বন্দর পর্যায়ে ভুয়া ঘোষণা ও জাল কাগজ দেখিয়ে প্রবেশ করে। এরপর রাতের আঁধারে গুদাম হয়ে ছড়িয়ে পড়ে খুচরা ও পাইকারি বাজারে।
গত ২২ মে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ ‘কমলালেবু’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া একটি কনটেইনার থেকে ১ কোটি ২৫ লাখ স্টিক বিদেশি সিগারেট জব্দ করে। এ চালানে প্রায় ৩০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা ছিল বলে জানায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
গত বছরের অক্টোবরে নগরের হালিশহর ও নয়াবাজারে যৌথ অভিযানে ভুয়া ব্যান্ডরোল ও বিদেশি সিগারেট পেপার জব্দ করা হয়েছিল। এর আগে ২০২১ সালে প্রায় ১৫ মিলিয়ন স্টিক সিগারেট জব্দ হলেও চলতি বছর তা বেড়ে এরই মধ্যে ৫৫ মিলিয়নে পৌঁছেছে।
রিয়াজউদ্দিন বাজারে একই চিত্র প্রসাধন সামগ্রীর ক্ষেত্রেও। ২০২১ সালে মাত্র ৫ কোটি টাকার প্রসাধনী জব্দ হয়েছিল। ২০২৫ সালে এসে এ সংখ্যা এরই মধ্যে প্রায় ২৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
যেভাবে আসে অবৈধ সিগারেট ও প্রসাধনী
কাস্টমস কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যমতে, ‘ফল’, ‘স্ট্র পেপার’ বা ‘রিবন’ - এমন ভুয়া ঘোষণা দিয়ে সিগারেট বা সিগারেট পেপার আনার প্রবণতা বেড়েছে। গত সপ্তাহেই ‘স্ট্র পেপার’ ও ‘রিবন’ ঘোষণা দেওয়া দুই চালানে সিগারেট পেপার ধরা পড়ে। যার পেছনে কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে।
শুধু অভিযানে সমস্যার সমাধান হবে না। বন্দরে স্বচ্ছ স্ক্যানিং ও ট্রান্সশিপমেন্টের ওপর কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। এখানে একটি চোরাকারবারি চক্র কাজ করছে। যতক্ষণ না সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা না হবে, ততক্ষণ এ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে।- বলেন একজন শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা
বন্দর থেকে ‘রাতের ডেলিভারি’
বিভিন্ন সময় অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া একাধিক সূত্র জানায়, ভুয়া ঘোষণায় পণ্য ছাড়িয়ে নেওয়ার পর সেগুলো নয়াবাজার, রিয়াজউদ্দিন বাজার ও হালিশহর ঘেঁষা বিভিন্ন গুদামে ওঠে। বেশিরভাগ পণ্য খালাস হয় রাতেই। দিনভর সেগুলো খুচরা আর পাইকারিতে আড়তে নেওয়া হয়।
বাজারের ভেতরের কথা
রিয়াজউদ্দিন বাজারের একজন পাইকারি ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বৈধপথে পণ্য আমদানিতে দাম বেশি পড়ে, লাভ হয় কম। অবৈধ চালান ঢুকলে পুরো বাজারটাই ‘আনফেয়ার’ হয়ে যায়। তখন বড় অঙ্কের লাভ হয়।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সাম্প্রতিক মাসগুলোতে একাধিক বড় চালান ধরেছে। কখনো ‘কমলালেবু’, কখনো ‘ওয়াটার ফিল্টার’, কখনো ‘স্ট্র-রিবন’ নামে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বন্দর স্ক্যানিং, ঝুঁকি প্রোফাইলিং ও পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিট জোরদার হওয়ায় ধরা পড়ার হার বাড়ছে। তবে সরবরাহ শৃঙ্খল পুরোপুরি ভাঙতে আরও সমন্বয় করা দরকার।
রিয়াজউদ্দিন বাজারের স্থানীয় একজন বৈধ আমদানিকারক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা সঠিক শুল্ক দিয়ে পণ্য আনলে খরচ অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু সিন্ডিকেট শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অর্ধেক দামে বাজার ভরিয়ে দিচ্ছে। এতে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। আমাদের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অসাধু ব্যবসায়ীরা আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে। এসব বন্ধের জন্য প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।’
আজিম উদ্দিন নামের এক কসমেটিকস দোকানদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘দিনে ও রাতে প্রশাসনের সামনে কিংবা চোখ ফাঁকি দিয়ে বাজারে অবৈধ ব্যবসা চলছে। প্রশাসন দেখেও যেন না দেখার ভান করছে। প্রশাসনের কেউ কেউ ব্যবসায়ীদের থেকে অবৈধ ব্যবসার ভাগ নেন।
তিনি বলেন, ‘মাঝেমধ্যে লোক দেখানো কিছু অভিযান চালায় প্রশাসন। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে আমাদের ব্যবসায় ভাটা পড়ছে।’
সিন্ডিকেট ভাঙা কঠিন। কারণ, এর সঙ্গে কিছু অসাধু আমদানিকারক, পরিবহনকর্মী এমনকি প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও জড়িত।- বণিক সমিতির নেতা সাদেক হোসাইন
শুল্ক ফাঁকির এ মালামাল কীভাবে বাজারে আসছে—জানতে চাইলে বাজারের সচেতন এক ব্যবসায়ী জানান, ফল/ফিল্টার/স্ট্র-রিবন এমন এইচএস (HS) কোডে ঘোষণা দিয়ে সিগারেট বা সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল আনা হয়। ফেক ডকুমেন্ট বা ফাঁকা বিল অব অ্যান্ট্রি করে পরে দ্রুত শিপমেন্ট করে। পণ্যগুলো রাতে গুদামে ওঠানোর পর দিনে পাইকারি ও খুচরা বাজারে ছাড়া হয়। এমনকি কুরিয়ার সার্ভিস, পিকআপভ্যান বা মোটরসাইকেলেও নগরীর বাইরে বিভিন্ন দোকানে এগুলো সরবরাহ হয়।
অবৈধ পণ্য সরবরাহ বন্ধে প্রশাসনের পদক্ষেপ বিষয়ে জানতে চাইলে একজন শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুধু অভিযানে সমস্যার সমাধান হবে না। বন্দরে স্বচ্ছ স্ক্যানিং ও ট্রান্সশিপমেন্টের ওপর কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। রিয়াজউদ্দিন বাজারের মতো পাইকারি আড়তেও নিয়মিত পর্যবেক্ষণ জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘এখানে একটি চোরাকারবারি চক্র কাজ করছে। যতক্ষণ না সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা না হবে, ততক্ষণ এ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে।’
তামাকুমন্ডি লেইন বণিক সমিতির সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক সাদেক হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গোপনে এ কাজকর্ম চালায়। আমরা বণিক সমিতি স্পষ্ট এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময় এই অসাধু ব্যবসায়ীদের দোকানে প্রশাসনের অভিযানে আমরা সহযোগিতা করি।’
সিন্ডিকেট ভাঙার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিন্ডিকেট ভাঙা কঠিন। কারণ, এর সঙ্গে কিছু অসাধু আমদানিকারক, পরিবহনকর্মী এমনকি প্রভাবশালী ব্যক্তিও জড়িত।’
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) জনসংযোগের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শ্রীমা চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘রিয়াজউদ্দিন বাজার চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী পুরোনো বাজার। এখানে চোরাই মোবাইল ফোনসহ যে কোনো চোরাই পণ্য বেচাকেনা রোধে পুলিশের নিয়মিত অভিযান হয়। চোরাই ফোন উদ্ধার হয়।’
তিনি বলেন, ‘মোবাইল ফোন, কসমেটিকস কিংবা সিগারেট যে পণ্যই হোক না কেন, চোরাই পণ্য তো চোরাই-ই। চোরাচালান কিংবা চোরাই পণ্য বেচাকেনা রোধে রিয়াজউদ্দিন বাজারসহ নগরীতে সিএমপির গোয়েন্দা নজরদারি থাকে।’
হুন্ডি লেনদেন নিয়ে নগরীর স্টেশন রোড, জুবিলী রোড শাখার বেশ কয়েকটি তপসিলি ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাদাভাবে কথা হয় জাগো নিউজের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, ‘বেশকিছু ব্যাংকে বিগত সময়ে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। যে কারণে টাকা জমার ক্ষেত্রে ডকুমেন্ট নিয়ে গ্রাহকদের চাপাচাপি করা হয় না। অনেক হিসাব আছে মোবাইল কিংবা ইলেক্ট্রনিক পণ্যের দোকানের নামে। এসব হিসাব থেকে দেশের বিভিন্ন জেলার হিসাবে টাকা পাঠানো হয়। ওইসব জেলা থেকে কোনো ইলেক্ট্রনিক পণ্য আসার সুযোগ নেই।’
‘দেখা যাচ্ছে, নিয়মিতই মাসের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হিসাবে টাকা পাঠাচ্ছেন গ্রাহকরা। এক্ষেত্রে এক ব্যাংক চাপাচাপি করলে অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেন। আবার কিছু ব্যাংকে তারল্য সংকট কাটাতে এসব লেনদেনে নিরুৎসাহিত করা হয় না’- বলছেন এই কর্মকর্তারা।
কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রামের যুগ্ম পরিচালক চপল চাকমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দেশের বাইরে থেকে আসা পণ্য দেশের বাজারে বিক্রি অপরাধ। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসা বিদেশি পণ্যের ব্যবসার বিষয়গুলো মনিটরিং করা হয়। রিয়াজউদ্দিন বাজারে এসব চোরাচালানের পণ্য বিক্রির বিষয়টিও আমরা তদন্ত করে দেখবো।’
এমআরএএইচ/এমকেআর/এমএফএ/এমএস