যেভাবে সবাই বলে সেভাবে আর কিশোর গ্যাং নেই

রাসেল মাহমুদ
রাসেল মাহমুদ রাসেল মাহমুদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:২৩ এএম, ১৯ নভেম্বর ২০২২

রাজধানীতে প্রতিদিনই ঘটছে নানা অপরাধ। এসব অপরাধ দমন এবং নিয়ন্ত্রণে তৎপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে রাজধানীর সব এলাকায় অপরাধের ধরন একরকম নয়। কোথাও হয়তো চুরি-ছিনতাই বেশি, কোথাও আবার মাদক বা অন্যান্য অপরাধ বেশি। ফলে এসব অপরাধ দমনে সারাবছরই তৎপর থাকতে হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে রাজধানীবাসীর নতুন করে মাথাব্যথার কারণ কিশোর গ্যাং। কিশোরদের নিয়ে গঠিত এসব গ্যাংয়ের সবাই যে অপরাধে জড়াচ্ছে তা নয়। তবে মাঝেমধ্যেই কিশোর গ্যাংয়ের নানা অপরাধের খবর গণমাধ্যমে আসে। এমনকি নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, দ্বন্দ্ব বা নানা কারণে কয়েকটি হত্যার ঘটনাও ঘটিয়েছে এসব কিশোর গ্যাং।

কিশোং গ্যাংয়ের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে রাজধানীর উত্তরা এলাকা। ওই এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কাজ করে ডিএমপির উত্তরা বিভাগ। উত্তরাসহ রাজধানীর অন্যান্য এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মোর্শেদ আলমের সঙ্গে কথা বলেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক রাসেল মাহমুদ। ক্যামেরায় ছিলেন জাগো নিউজের ফটোগ্রাফার মাহবুব আলম।

জাগো নিউজ: উত্তরা বিভাগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এই মুহূর্তে কেমন?
মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম: এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো ভালো আছে। বিশেষ কোনো অবনতি এখনো এখানে নেই। সাধারণত যেসব অপরাধ সব জায়গায় রয়েছে সেগুলো এখানেও আছে, তবে সেটা সীমিত পর্যায়েই রয়েছে।

জাগো নিউজ: পরিস্থিতি ভালো বলছেন। তবে সারাদেশেই মাদকের ছড়াছড়ি। মাদক কারবার বন্ধ করতে পেরেছেন?
মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম: মাদকের কারবার বন্ধ হয়েছে তা বলবো না, তবে সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। এখানে মাদক কারবারের বড় কোনো ডিলার নেই বললেই চলে। এখানে কিছু মাদক ট্রেনের মাধ্যমে আসে। যখন ট্রেন আসে তখন বিমানবন্দর স্টেশনে আমরা বিশেষ অভিযান চালাই। সে সময় সাধারণত গাঁজা পাওয়া যায়। এর বাইরে ইয়াবা উদ্ধার হয় কখনো কখনো।

আরও পড়ুন: ‘হিরোইজম’ প্রকাশে পাড়া-মহল্লায় গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং 

জাগো নিউজ: ডিএমপিতে চুরির বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চোরের তালিকা করা হয়েছে। আপনার এলাকায় এ অপরাধের মাত্রা কেমন?
মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম: থানাগুলোতে চোরের তালিকা রয়েছে। এরা আসলে পেশাদার চোর নয়। চোর যেটা শনাক্ত হয় তা টঙ্গী থেকে বা ঢাকার বাইরে থেকে এসে এখানে চুরি করে। এ ধরনের চোর প্রায়ই ধরা পড়ে। গত এক মাসে ২০ থেকে ২২টি চুরির ঘটনা ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা পেশাদার চোর তারা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ফলে তাদের ধরা যায় না।

জাগো নিউজ: উত্তরা এলাকায় বেশ কিছু কিশোর গ্যাংয়ের বিষয় প্রায়ই আলোচনায় আসে। এখানে কিশোর গ্যাং বেড়ে ওঠার কারণ কী?
মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম: ডিএমপির উত্তরা বিভাগের জন্য কিশোং গ্যাং অনেকটা দোষের মতো হয়ে গেছে। এর কারণ, একসময় এখানে কিশোর গ্যাংয়ের অনেক উপদ্রব ছিল। অনেকগুলো গ্যাং ছিল, ছোট ছোট গ্রুপ ছিল। দক্ষিণখান থানায় কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্বে এক শিক্ষার্থী মারাও যায়। ওই ঘটনাকে টেনেই মূলত উত্তরাতে কিশোর গ্যাংয়ের একটা অবস্থান আছে বলে সবাই ধরে নেয়। কিন্তু বর্তমানে এই অবস্থার যে অনেক উন্নতি হয়েছে এটা কেউ বলতে চায় না। সাম্প্রতিক সময়ে উত্তরা বিভাগে কিশোর গ্যাংয়ের করা কোনো ঘটনা বা মামলা পাবেন না। অথচ যেভাবে সবাই বলে যে উত্তরাতে কিশোর গ্যাং আছে। গত এক বছরে আমার মনে হয় না দুই-তিনটার বেশি ঘটনা ঘটেছে বা মামলা হয়েছে। যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো মারামারি সংক্রান্ত। এটা বলতে পারেন সেগুলো কিশোররা করেছে। এই হিসেবে হয়তো কিশোর গ্যাং বলতে পারেন। কিন্তু গ্যাং তৈরি হয়ে মারামারি করছে- এ ধরেন ঘটনা গত এক বছরে খুব একটা ঘটেনি।

জাগো নিউজ: উত্তরাতে অনেক কিশোর গ্যাং আছে- এই ধারণা হওয়ার কারণ কী?
মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম: এখানে অনেক স্কুল-কলেজ আছে। যেগুলোতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। যে বয়সীদের কিশোর গ্যাং হিসেবে বলা হয় তাদের বয়সও তেমনই। এরা স্কুল ছুটির পর বা বিভিন্ন সময় রাস্তাঘাটে গল্প করে। অনেকেই ভাবে এরাই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। আসলে বিষয়টি তেমন নয়। তারা সাধারণ শিক্ষার্থী।

আরও পড়ুন: ঢাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুপক্ষের সংঘর্ষ, তরুণকে ছুরিকাঘাত

জাগো নিউজ: কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে কোন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন বা নিচ্ছেন?
মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম: আসলে অনেকেই মনে করেন উত্তরাতে এত কিশোর গ্যাং আছে, এতগুলো গ্রুপ আছে, রীতিমতো মারামারি করে- এই ধরনের অবস্থা এখন আর নেই। এখন অনেক উন্নত হয়েছে। সব থানায় কিশোর গ্যাংয়ের ওপর পর্যাপ্ত কাজ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সব থানায় রেজিস্টার মেইনটেইন করা হয়। যারা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়তে পারে তাদের নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে আসি। ডাটাবেজ করা হয়। থানাগুলোতে নিয়মিত এটা করা হয়। যাদেরকে বেশি সন্দেহজনক মনে হয় তাদেরকে এবং তাদের অভিভাবকদের থানায় এনে কাউন্সেলিং করে থাকি। তবে কিশোর গ্যাং একেবারেই কম বললেই চলে।

জাগো নিউজ: কিশোর গ্যাংয়ের মাধ্যমে ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি আদনান কবির, ২০২০ সালের ১১ মে আরেফিন শাকিল হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর বিচার এখন কোন পর্যায়ে?
মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম: মামলার তদন্ত শেষে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। মামলা এখন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

জাগো নিউজ: স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা এসব গ্যাং পৃষ্ঠপোষকতা করেন বলে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন হয়েছে। এসব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আপনারা ইন্ধনদাতা হিসেবে কাদেরকে পেয়েছেন? তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?
মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম: আসলে এটা অনেক জায়গায় হতে পারে। কিন্তু আমি এখানে পাইনি যে কারোর আশ্রয়ে কিশোররা এরকমটা করে। সুতরাং কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কোনো পরিবেশ তৈরি হয়নি। কারোর ছেলে হয়তো নানা কারণে ছোটবেলা থেকেই উড়নচণ্ডী থাকতে পারে। সে বন্ধুবান্ধব নিয়ে একটা গ্রুপ তৈরি করে। অনেকে আছে তার রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতে পারে, ছোটবেলা থেকেই তারা সংগঠক হিসেবে থাকতে পারে। কিন্তু কোনো রাজনীতিবিদ কিশোর গ্যাং পালেন, কিশোর গ্যাং দিয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণের পরিবেশ তৈরি করেন- এগুলো পাইনি।

আরও পড়ুন: কীভাবে বুঝবেন আপনার সন্তান গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে 

জাগো নিউজ: কিশোর গ্যাংসহ চুরি, ছিনতাই, মাদক কমাতে কমিউনিটি পুলিশিং সেবা কতটা ভূমিকা রাখতে পারছে?
মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম: কমিউনিটি পুলিশিং সবসময়ই ইতিবাচক সেবা দিয়ে থাকে এবং সমাজের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। তবে ২০১৯ সালের পর থেকে যেহেতু কোভিডের বিস্তার ছিল, সে সময় কমিউনিটি পুলিশংয়ের কর্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হয়। এখন কোভিড কমেছে, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কর্যক্রম চলমান রয়েছে।

জাগো নিউজ: অপরাধ বিষয়ক মাসিক পর্যালোচনা সভায় কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য দেওয়া হয়?
মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম: যেসব অপরাধ ঘটে সেটার পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এছাড়া যেসব অপরাধ এক মাস ঊর্ধ্বগতিতে থাকে সেগুলো যাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তার প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

জাগো নিউজ: থানাগুলোতে সেবার মান বাড়াতে বলেছেন আইজিপি। আপনাদের পরিকল্পনা কী?
মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম: আইজিপি হিসেবে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন যোগদানের পরপরই থানার সেবার মান বাড়াতে আমাদের নির্দেশনা দেন। আমরাও আমাদের বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছি। আমরা নিয়মিত থানায় যাই, থানা পর্যবেক্ষণ করি। যারা সেবা নিতে আসেন তাদের সঙ্গে কথা বলি। সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে পুলিশের আচরণ ও কোনো ধরনের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা যেন না থাকে এ বিষয়ে তদারকি করা হয়। এ ধরনের কোনো অভিযোগ পেলে আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়ে থাকি। প্রতি মাসে ৫ থেকে ১০ জন এমন শাস্তি পান।

আরও পড়ুন: আদনান হত্যার অভিযোগে ২৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট

জাগো নিউজ: উত্তরা এলাকার জনগণ পুলিশের সহায়তা ও সেবা নিতে কতটুকু আস্থা পাচ্ছে বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম: আমার অফিসে এতো সংখ্যক লোক আসে যে এখানে এসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। আমি অফিসের কাজ করতে পারি না। এতো লোক যদি ডিসি অফিসে আসে সেবা নিতে, তাহলে থানার কী অবস্থা সেটা চিন্তা করেন। আমি মনে করি সেবার মান অবশ্যই অনেক বেড়েছে। মানুষও পুলিশের ওপর অনেক আস্থাশীল। পুলিশের কাছে মানুষ আসে এবং সেবা নিতে আগ্রহী।

জাগো নিউজ: আগামী বছর নির্বাচন। এরইমধ্যে রাজনৈতিক নানা কর্মসূচি শুরু হয়েছে। জননিরাপত্তা নিয়ে পুলিশের ভূমিকা কী থাকবে?
মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম: আমরা অপরাধ নিয়ে কাজ করি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিষয় নয়, পুলিশের কাজ সবসময় অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আইনে যেটা অপরাধ হবে সে বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে এটাই স্বাভাবিক।

জাগো নিউজ: ধন্যবাদ আপনাকে।
মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম: আপনাকে এবং জাগো নিউজ পরিবারকেও ধন্যবাদ।

আরএসএম/কেএসআর/এএসএম

ডিএমপির উত্তরা বিভাগের জন্য কিশোং গ্যাং অনেকটা দোষের মতো হয়ে গেছে। এর কারণ, একসময় এখানে কিশোর গ্যাংয়ের অনেক উপদ্রব ছিল। অনেকগুলো গ্যাং ছিল, ছোট ছোট গ্রুপ ছিল

উত্তরায় অনেক স্কুল-কলেজ আছে। যেগুলোতে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। যে বয়সীদের কিশোর গ্যাং হিসেবে বলা হয় তাদের বয়সও তেমনই। এরা স্কুল ছুটির পর বা বিভিন্ন সময় রাস্তাঘাটে গল্প করে। অনেকেই ভাবে এরাই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য

কারও ছেলে হয়তো ছোটবেলা থেকেই উড়নচণ্ডী থাকতে পারে। সে বন্ধুবান্ধব নিয়ে একটা গ্রুপ তৈরি করে। অনেকের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড থাকতে পারে, ছোটবেলা থেকেই তারা সংগঠক হিসেবে থাকতে পারে। কিন্তু কোনো রাজনীতিক কিশোর গ্যাং পালেন, কিশোর গ্যাং দিয়ে এলাকা নিয়ন্ত্রণের পরিবেশ তৈরি করেন- এগুলো পাইনি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।