‘আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করলে নারীকে যোগ্য করে তোলা হবে’

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:১৭ এএম, ০৫ এপ্রিল ২০২৩

অ্যাডভোকেট সালমা আলী। সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি। একই সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন অ্যাটসেক (অ্যাকশন এগেইনস্ট ট্রাফিকিং অ্যান্ড সেক্সুয়াল এক্সপ্লয়টেশন অব চিলড্রেন) দক্ষিণ এশিয়ার চেয়ারপারসন হিসেবে। কাজ করছেন নারী পাচার রোধ এবং প্রবাসী নারী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে।

প্রধানমন্ত্রী গৃহস্থালিতে নারীদের কাজের স্বীকৃতি এবং মূল্য নির্ধারণের যে নির্দেশনা দিয়েছেন সে প্রসঙ্গে কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

জাগো নিউজ: একনেক সভায় নারীদের কাজের হিসাব করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গৃহস্থলে নারীদের কাজের মূল্য যোগ হলে জাতীয় প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। এ নির্দেশনা অবশ্যই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে?

সালমা আলী: এটি আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি। শহর হোক বা গ্রাম হোক গৃহস্থলে নারীরা অক্লান্ত শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ, তাদের শ্রমের মূল্য দেওয়া হয় না। তাদের কাজের স্বীকৃতি নেই। গৃহকর্মীদের শ্রমেরও কোনো মূল্যায়ন নেই, স্বীকৃতি নেই। মুসলিম আইনের তালাক আর দেনমোহর নিয়েই আমরা পড়ে আছি।

আরও পড়ুন>> ‘কাম করি সমান কিন্তু টাকা দেয় বেডা মানুষের অর্ধেক’

প্রধানমন্ত্রী আজ যা বলেছেন, তা নারীদের প্রাণের কথা বলে অমি মনে করি। গৃহে নারীদের কাজের স্বীকৃতি চেয়ে আমরা বহুদিন থেকে সোচ্চার। বেসরকারি সংগঠনগুলোও এ নিয়ে কাজ করে আসছে। কাজের স্বীকৃতি শুধু মুখে বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না, তার অর্থনৈতিক মূল্যটা জরুরি। কাজের এই স্বীকৃতি তার ওপর যে দয়া করে নয়, বরং এটি যে তার অধিকার এ ধারণা প্রতিষ্ঠা দিতে হবে।

জাগো নিউজ: এই স্বীকৃতি তো কঠিন…

সালমা আলী: অবশ্যই কঠিন মনে করি। শুধু মুখে বললে হবে না। পলিসি লেভেল থেকে ভাবতে হবে। এজন্য অনেক করণীয় আছে। নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন বিভাগকে যুক্ত করতে হবে। সচেতন করে তুলতে হবে। প্রতিটি পরিবার থেকে এ নিয়ে কাজ করতে হবে।

জাগো নিউজ: উন্নত বিশ্বে নারীদের এমন কাজের স্বীকৃতির সঙ্গে তুলনা করে কী বলবেন?

সালমা আলী: অনেক দেশেই নারীর কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বৈষম্য সেখানেও ছিল। ইউরোপ-আমেরিকাতেও নারীদের কাজের মূল্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল এক সময়। এই স্বীকৃতির জন্য নারীরা ঘর থেকে বের হলো। আন্দোলন করলো। যার ফলশ্রুতিতে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস স্বীকৃতি পেল। ঘরে ও কর্মক্ষেত্রে নারীরা বৈষম্যের শিকার হতো। এখনো হয়। আমাদের এখানে এই বৈষম্য আরও তীব্র। গার্মেন্ট কারখানায় নারীরাই বেশি কাজ করছে। নিপুণ হাতে পোশাক তৈরি করছে। অথচ একটি কারখানায় দেখবেন উপরের স্তরে পুরুষরাই বসে আছে। নারী কাজ জানলেও তার স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। দক্ষ, যোগ্য হওয়ার পরেও নারীর সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। বেতন কম পাচ্ছে পুরুষের চেয়ে।

আরও পড়ুন>> আঞ্চলিক সড়কেও টোল আদায় করা হবে: প্রধানমন্ত্রী

পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব সর্বত্রই প্রকাশ পাচ্ছে। এমনকি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব নারীদের মধ্যেও রয়েছে। এই মনোভাবের পরিবর্তন সবার আগে ঘরের মধ্য থেকে তৈরি করতে হবে।

জাগো নিউজ: পুরুষেরা কীভাবে দেখতে পারেন কাজের এ স্বীকৃতি?

সালমা আলী: কোনো কোনো পুরুষ তো নারীর কাজকে কাজই মনে করেন না। নারী অবলা, নারী ভোগ্যপণ্য ছাড়া তো তারা কোনো কিছু ভাবতে পারেন না। তারা মনে করে নারী বেঁচে আছে পুরুষের দয়ার ওপর। তবে সব পুরুষই একই মূল্যায়ন করে না।

জাগো নিউজ: গৃহে নারীর শ্রমমূল্য বণ্টনের প্রক্রিয়া কী হতে পারে?

আরও পড়ুন>> বাড়ি বাড়ি ঘুরে নারী ক্ষমতায়নে কাজ করেন তারা

সালমা আলী: নারী-পুরুষ সমান অধিকার ভাবলেই বণ্টন সহজ হবে। পুরুষ বাইরে গিয়ে আট ঘণ্টায় কী মাইনে পাচ্ছে, তার সঙ্গে যোগ্যতা, শ্রমের সময়, কাজের মান যাচাই করে মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব। এটি আলোচনার ব্যাপার। এই আলোচনায় রাষ্ট্রও যুক্ত হতে পারে। অনেকেই তো গৃহকর্মীদের বেতন দেন। তাহলে স্ত্রী, মেয়ে, মা বা বোনের কাজের মূল্য দেবে না কেন? নারীকে সম্মানের জায়গা থেকে দেখলেই সমাধান হবে। ঘরে কাজ না করে বাইরে গিয়ে কাজ করলে তো নারী মূল্য পেতো। আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করলে নারীকে যোগ্য করে তোলা হবে।

জাগো নিউজ: এই শ্রমমূল্য জাতীয় অর্থনীতিতে অবশ্যই প্রভাব ফেলবে…

সালমা আলী: নারীর শ্রম বাদে তো অর্থনীতি চলতে পারে না। কোনো কোনো পরিবারে নারীর শ্রমই আসল। নারী শ্রম না দিলে ওই পরিবার অচল। গৃহস্থলে নারী শ্রমের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিললে অর্থনীতি আরও চাঙা হবে। প্রবৃদ্ধি বাড়বে। নারীরা আরও স্বাবলম্বী হবেন। সমতা, ক্ষমতায়ন প্রশ্নে এটি খুব জরুরি। নারী নির্যাতনের মাত্রাও অনেক কমে যাবে। নারীর ব্যাংক হিসেবে টাকা না গেলে, তার হাতে নগদ টাকা না থাকলে নারীর সত্যিকার ক্ষমতায়ন হবে না। এমন হলে নারী-পুরুষের মানসিক পরিবর্তনও আসবে।

জাগো নিউজ: আবার অশান্তি সৃষ্টিরও কারণ হতে পারে! গৃহে কলহ লেগেই থাকতে পারে এই মূল্য পরিশোধ নিয়ে?

আরও পড়ুন>> সব জেলায় নারী সার্কেল এসপি দিতে চাই: আইজিপি

সালমা আলী: শ্রমের মূল্য চেয়ে নিতে হবে এমনটি হলে কলহ লাগতেই পারে। কিন্তু এমনটা যেন না হয়। শ্রমের মূল্য চেয়ে নেবে কেন? এটি দিতে বাধ্য। এজন্যই বলেছি একদম পলিসি লেভেল থেকে এটি ব্যবস্থা করতে হবে। সিদ্ধান্তটা এমন হোক যে, একজন পুরুষ সরকারি অফিসে চাকরি করছেন আর নারী ঘরের কাজ সামলাচ্ছেন। ওই পুরুষের পাওয়া বেতনের একটি অংশ তার স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে চলে যাক। আলোচনা করে সমাধান করলে অশান্তি হওয়ার কথা না। চাপিয়ে দিলেই সমস্যা। স্বামী, ছেলে বা শ্বশুরের দয়ায় নারী বেঁচে আছে- এমন ধারণা দূর হয়ে যাক। কারণ নারী ঘরে থাকলেও স্বামী, ছেলে বা শ্বশুরের জন্যই কাজ করেন।

এএসএস/এএসএ/এমএস

পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব সর্বত্রই প্রকাশ পাচ্ছে। এমনকি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব নারীদের মধ্যেও রয়েছে। এই মনোভাবের পরিবর্তন সবার আগে ঘরের মধ্য থেকে তৈরি করতে হবে।

নারীকে সম্মানের জায়গা থেকে দেখলেই সমাধান হবে। ঘরে কাজ না করে বাইরে গিয়ে কাজ করলে তো নারী মূল্য পেতো। আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করলে নারীকে যোগ্য করে তোলা হবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।