জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

অকালে শিশুর জন্ম, অকালেই মৃত্যু

মোঃ সামিউর রহমান সাজ্জাদ
মোঃ সামিউর রহমান সাজ্জাদ মোঃ সামিউর রহমান সাজ্জাদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:০২ পিএম, ৩০ নভেম্বর ২০২৪
দেশে অকালে শিশুর জন্ম বাড়ছে, মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে/জাগো নিউজ গ্রাফিক্স

• তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে গর্ভবতী নারীদের অকাল প্রসবের সম্ভাবনা ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়
• বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জনে অকাল জন্মহার ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ, যা ভারতে ১৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ
• অকাল জন্মহারের দিক থেকে ১০৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম
• কম ওজনের জন্মহারের দিক থেকে ১৫৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয়

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তামান্না খাতুন (ছদ্মনাম)। সম্প্রতি তিনি গর্ভধারণ করেন। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। প্রসবের সময় তার গর্ভের সন্তান মৃত হয়ে জন্ম নেয়। চিকিৎসক তাকে বলেছেন, তীব্র গরমে বাইরে বেশি দৌড়ঝাপ করার কারণে এমনটা হতে পারে।

গত ১৭ নভেম্বর পালিত হলো বিশ্ব অকাল-জন্ম দিবস (প্রিম্যাচুউরিটি) দিবস। অপরিণত নবজাতকের মৃত্যুতে বিশ্বে অন্যতম শীর্ষ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন নবজাতক অকাল জন্মজনিত জটিলতায় মারা যায়। বছরে পাঁচ লাখ ৭৩ হাজার জন অপরিণত শিশু জন্মগ্রহণ করে, যা মোট জন্মলাভ করা শিশুর ১৯ দশমিক ১ শতাংশ। এই অপরিণত শিশুর মৃত্যুহার অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরে ২২ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহ আগে জীবিত জন্ম নেওয়া শিশুদের অপরিণত শিশু বলে। এরা স্বাভাবিকের (আড়াই কেজি) চেয়ে কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এদের লো বার্থ ওয়েট, বাংলায় যাকে বলা হয় স্বল্প ওজন নিয়ে ভূমিষ্ঠ শিশু।

এদের মধ্যে জন্ম-পরবর্তী নানা প্রতিকূল সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেমন শ্বাসতন্ত্র, কিডনি, বিপাকক্রিয়ায় দুর্বলতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ইত্যাদি। এরা শারীরিক সক্ষমতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশেও পিছিয়ে থাকে।

শিশু মৃত্যু রোধের তাগিদ দিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে বর্তমানে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশুর মৃত্যুর প্রতি হাজারে ৩১ থেকে ২৫ জনে এবং নবজাতকের মৃত্যু প্রতি হাজারে ২০ থেকে ১২ জনে নামাতে হবে।

‘বিগত পাঁচ-দশ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনে মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে তেমন কথা না বলা হলেও ইদানীং বলা হচ্ছে। প্রায় ৭০টি গবেষণায় দেখা গেছে যে তাপমাত্রার সঙ্গে মাতৃস্বাস্থ্যের সম্পর্ক আছে। এমনকি সম্প্রতি ১৪টি দেশের জনসংখ্যাগত স্বাস্থ্য জরিপ এবং আবহাওয়া উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একই তথ্য পাওয়া গেছে।’- বিজ্ঞানী আহমেদ এহসানূর রহমান

জলবায়ু পরিবর্তন, বেড়েছে তাপপ্রবাহ

গত ছয় দশকে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে প্রায় এক ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়েছে। গত এক দশকে গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেও এর প্রভাব ভয়ানক। কারণ, গড় তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়া মানে একক দিনে এটি কয়েক ডিগ্রি বেড়েছে। যার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে মাতৃস্বাস্থ্যে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর চার লাখ ৮৮ হাজার ৬০০ অপরিণত শিশু জন্ম নেয়, যা বিশ্বের ১০৩টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক। অপরিণত ও কম ওজনে জন্ম নেওয়ার কারণে দেশে প্রতি ঘণ্টায় মারা যায় তিন নবজাতক।

গবেষণা অনুযায়ী, অতিরিক্ত গরমে গর্ভবতী মায়ের শরীরের ওপর কী প্রভাব পড়ে এবং তার জন্ম হওয়া সন্তানের ওপর কী প্রভাব পড়ে এ বিষয়ে অনেকেই জানেন না। যখন একজন গর্ভবতী মা অতিরিক্ত গরমের মধ্যে থাকেন, তখন তার গর্ভের শিশুর ওপর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। ফলে সন্তানের মৃত্যু, জন্মের সময় ওজন কম এবং গর্ভধারণের সময় কম হতে পারে।

আইসিডিডিআর,বির মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী আহমেদ এহসানূর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘তাপমাত্রা বৃদ্ধি মূলত দুভাবে স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। শক ও স্ট্রেস। বিগত পাঁচ-দশ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনে মাতৃস্বাস্থ্য নিয়ে তেমন কথা না বলা হলেও ইদানীং বলা হচ্ছে। প্রায় ৭০টি গবেষণায় দেখা গেছে যে তাপমাত্রার সঙ্গে মাতৃস্বাস্থ্যের সম্পর্ক আছে। এমনকি সম্প্রতি ১৪টি দেশের জনসংখ্যাগত স্বাস্থ্য জরিপ এবং আবহাওয়া উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একই তথ্য পাওয়া গেছে।

২০২১ সালে ইউনিসেফের শিশুদের জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে ১৬৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫তম। ইউনিসেফ প্রকাশিত ‘প্রোটেকটিং চিলড্রেন ফ্রম হিট স্ট্রেস’ তীব্র তাপমাত্রার প্রভাব থেকে শিশুদের সুরক্ষা শীর্ষক একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, শীতকালের তুলনায় উচ্চ তাপমাত্রার সময় সন্তান প্রসব হলে সেই সন্তানদের জন্মের পরপর অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ১৪ শতাংশ বেশি থাকে।

নেচার জার্নালে প্রকাশিত ‘মাতৃ, ভ্রূণ এবং নবজাতকের স্বাস্থ্যের ওপর তাপের মাত্রায় প্রভাবগুলোর একটি পদ্ধতিগত পর্যালোচনা এবং মেটা-বিশ্লেষণ’ শীর্ষক একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে তাপমাত্রা প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধিতে অকাল জন্মের সম্ভাবনা ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যা তাপপ্রবাহ বেড়ে ২৬ শতাংশে পৌঁছায়।

আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে উচ্চ তাপমাত্রায় অকাল জন্মের ঘটনা বেশি ঘটে। পাশাপাশি উচ্চ তাপমাত্রা ওজন হ্রাসের অন্যতম কারণ। অন্যদিকে, প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে মৃত প্রসবের সংখ্যা ১ দশমিক ০৫ গুণ বেড়েছে।

পাশাপাশি, গর্ভাবস্থায় বাইরের তাপমাত্রা এবং তাপের প্রভাবে অপরিণত শিশু জন্ম, কম ওজনের শিশু জন্ম, গর্ভপাত এবং মৃত জন্মের মতো জন্মগত সমস্যা হতে পারে, বিশেষ করে কম আয়ের দেশগুলোতে।

দ্যা ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জনে অকাল জন্মহার ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ, যা ভারতে ১৩ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। অকাল জন্মহারের দিক থেকে ১০৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম এবং কম ওজনের জন্মহারের দিক থেকে ১৫৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

এ হিসাবে প্রতিদিন এক হাজার ৩৪০ শিশু এবং ঘণ্টায় ৫৬টি অপরিণত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে, যা অকাল শিশু জন্মহারে সারাবিশ্বে সর্বোচ্চ।

‘তীব্র তাপপ্রবাহ গর্ভবতী মায়েদের অপরিণত শিশু জন্মদানের অন্যতম প্রধান কারণ। একজন গর্ভবতী মায়ের শরীরে একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে তাপমাত্রা বেশি থাকে। কারণ সে আরেকটি প্রাণকে নিজের শরীরে ধারণ করে।- আইসিসিডিআর,বির বিজ্ঞানী আহমেদ এহসানূর রহমান

গর্ভবতী মায়েদের ওপর তাপপ্রবাহের প্রভাব

বাংলাদেশে গত এপ্রিল ও মে মাসে তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা দেয়। এ সময় দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে তাপপ্রবাহ দীর্ঘস্থায়ী, আরও তীব্র এবং ঘন ঘন হচ্ছে। এমনকি সেপ্টেম্বরেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। তাপপ্রবাহ থাকায় কিছুদিনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় সরকার। তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় অন্তঃসত্ত্বা নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অকালে শিশুর জন্ম, অকালেই মৃত্যু

গর্ভধারণকালে নারীদের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। সে কারণে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের ওপর তাপপ্রবাহের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অতিরিক্ত তাপপ্রবাহ ও গরমে অস্বস্তি বোধ করার পাশাপাশি পানিশূন্যতাও দেখা দিতে পারে। ফলে অপরিণত সন্তান জন্মদান ও জন্মের সময় শিশুর ওজন কম হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

আইসিসিডিআর,বির বিজ্ঞানী আহমেদ এহসানূর রহমান বলেন, ‘তীব্র তাপপ্রবাহ গর্ভবতী মায়েদের অপরিণত শিশু জন্মদানের অন্যতম প্রধান কারণ। একজন গর্ভবতী মায়ের শরীরে একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে তাপমাত্রা বেশি থাকে। কারণ সে আরেকটি প্রাণকে নিজের শরীরে ধারণ করে। ফলে বাইরের থেকে অতিরিক্ত তাপ, বিশেষ করে তাপপ্রবাহের সময়, গর্ভবতী মায়ের প্রিক্ল্যাম্পসিয়া (উচ্চ রক্তচাপজনিত একটি সমস্যা), অকাল জন্ম এমনকি ২৮ সপ্তাহের কম হলে মৃতপ্রসবও হতে পারে।’

বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বার্ষিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে হিট-স্ট্রেসের কারণে একদিকে গর্ভবতী প্রিক্ল্যাম্পসিয়া মায়েদের ঝুঁকি বাড়ছে অন্যদিকে অকাল জন্ম, মৃতপ্রসবের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের মতো নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশে তীব্র গরমের এই প্রভাব আরও মারাত্মক।

একজন অপরিণত বাচ্চার জন্য কম তাপমাত্রাও খারাপ, আবার বেশি তাপমাত্রাও খারাপ। ফলে অনেক সময় ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে কম তাপমাত্রা হলে স্পেশাল কেয়ার, ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও বেশি তাপমাত্রার ক্ষেত্রে এমন কোনো পদ্ধতি নেই।- অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার

তাপপ্রবাহ এবং অকাল প্রসব

ইউনিসেফের তথ্যমতে, তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে গর্ভবতী নারীদের অকাল প্রসবের সম্ভাবনা ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। এই ঝুঁকি সাধারণ গরম দিনের তুলনায় তীব্র তাপপ্রবাহের দিনে ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ফলে অকাল প্রসবের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশে অকাল জন্মহার ১৬ দশমিক ২ শতাংশ, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ।

ইউনিসেফের সাম্প্রতিক অনুমান অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের ৩ কোটি ৫৫ লাখ শিশু, যা সেই সময়ের মোট শিশু জনসংখ্যার ৯৯ শতাংশ, তীব্র তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হবে। অর্থাৎ, বছরে গড়ে ৪ দশমিক ৫ বা তার বেশি তাপপ্রবাহ হবে। এটি ২০২০ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে, যখন মাত্র ২৬ লাখ শিশু অর্থাৎ ৫ শতাংশ এই ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন ছিল।

ইউনিসেফের ২০২১ চিলড্রেনস ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স (সিসিআরআই) অনুসারে, বাংলাদেশের শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ‘অত্যন্ত উচ্চ ঝুঁকিতে’ রয়েছে। তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি গুরুতর ঝুঁকির সৃষ্টি করে, বিশেষ করে নবজাতক, শিশু এবং অল্পবয়সী শিশুদের জন্য যারা তাপ-সম্পর্কিত অসুস্থতা যেমন হিট স্ট্রোক এবং ডিহাইড্রেশনের কারণে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে দেশে অপরিণত শিশুর জন্মসংখ্যা ছিল ১ লাখ ৮৪ হাজার ৬৮৩ জন। জন্মহার ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। মৃত্যু হয়েছিল ১৬ হাজার ২৫২ জনের। ২০১১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে অপরিণত শিশুর জন্মসংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৯৬ হাজার ৬২৩ জনে। জন্মহার বেড়ে হয় ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। তবে মৃত্যুসংখ্যা কমে নেমে আসে ৯ হাজার ৪৩৮ জনে।

jagonews24

২০১৭ সালে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে অপরিণত শিশুর জন্মসংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ৪৬ হাজার ১৪৪ জনে। জন্মহার বেড়ে হয় ১১ দশমিক ৫ শতাংশ। মৃত্যুসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে পৌঁছায় ১৪ হাজার হাজার ৮৮৪ জনে। ২০২২ সালে অপরিণত শিশুর জন্মসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৯০০ জনে। জন্মহার বেড়ে হয় ২২ দশমিক ২ শতাংশ। মৃত্যুসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২৩ হাজার হাজার ৪০২ জনে।

চিকিৎসকদের মতে, সময়ের আগেই জন্ম নেওয়া এসব অপরিণত শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকির পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য জটিলতার ঝুঁকিও থাকে। অপরিণত শিশুরা সেরিব্রাল পালসি, মানসিক বিকাশে বিলম্ব, মৃগীরোগসহ অন্ধত্বের ঝুঁকিতে থাকে।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিটোমেটারনাল মেডিসিন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাধারণত আমরা দেখি যে শীতকালে হাঁপানি, নিউমোনিয়া, শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যায় অকাল মৃত্যু বেশি হয়। তীব্র গরমে মায়ের গর্ভে এমব্রায়োজেনেসিস (ভ্রূণের বিকাশে) তীব্র গরম বাধা সৃষ্টি করে। প্রথম ৬-৮ সপ্তাহে একটি ভ্রুণের বিকাশ হয়। তখন শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটে। ফলে একজন স্বাভাবিক বাচ্চা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যেভাবে বাইরের তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে, একজন ৩৭ সপ্তাহের পূর্বে ভূমিষ্ঠ হওয়া অপরিণত শিশু সেটা পারে না।’

অর্থাৎ, একজন অপরিণত বাচ্চার জন্য কম তাপমাত্রাও খারাপ, আবার বেশি তাপমাত্রাও খারাপ। ফলে অনেক সময় ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক্ষেত্রে কম তাপমাত্রা হলে স্পেশাল কেয়ার, ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার দিয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও বেশি তাপমাত্রার ক্ষেত্রে এমন কোনো পদ্ধতি নেই। বলছিলেন ডা. নাহরীন আখতার।

• ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু
• ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি
• ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে তীব্র
• ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি তাপমাত্রাকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়

বাংলাদেশে তীব্র তাপপ্রবাহের প্রভাব ও পদক্ষেপ

২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে তীব্র তাপপ্রবাহ লক্ষ করা যাচ্ছে। সাধারণত এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত গরম বেশি অনুভূত হয়।

এ বছর মে মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইউনিসেফের সহায়তায় শিশু, গর্ভবতী নারীসহ সংবেদনশীল জনগোষ্ঠীদের তাপ সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে একটি জাতীয় নির্দেশিকা প্রকাশ করে।

নির্দেশিকা অনুযায়ী ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মৃদু, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে মাঝারি, ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে তীব্র এবং ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার চেয়ে বেশি তাপমাত্রাকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়।

তীব্র গরমের সময় শরীরে পানিশূন্যতা বেশি হয়। এতে গর্ভাবস্থা ও প্রসবোত্তর সময়ে গুরুতর সমস্যা হতে পারে। যেমন, জরায়ুতে পানির পরিমাণ কমে যেতে পারে, দুধ কম আসতে পারে। এছাড়া অকাল প্রসবের কারণও হতে পারে পানিশূন্যতা।

এই নির্দেশিকা অনুযায়ী, তীব্র গরমে গর্ভবতী নারী আর তাদের গর্ভস্থ শিশুরা বিশেষভাবে ঝুঁকিতে থাকে। গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ত্রৈমাসিকের নারীরা শারীরিক পরিবর্তনের কারণে অতিরিক্ত গরমের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়েন।

অতিরিক্ত গরমে থাকলে মায়ের মানসিক চাপ বাড়তে পারে, উচ্চ রক্তচাপ ও প্রসবজনিত জটিলতা দেখা দিতে পারে, প্রসবকালে সমস্যা হতে পারে এবং অকাল প্রসব হতে পারে।

‘আমরা যারা শহরে থাকি তারা এসি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছি কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ সেই সুযোগ পাচ্ছে না। যতদূর সম্ভব সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তীব্র গরমে বাইরে বের না হওয়া, বেশি পানি পান করা যাতে পানিশূন্যতা না হয়, ছায়াযুক্ত স্থানে থাকা ইত্যাদি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।’- অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার

করণীয়

বিএসএমএমইউর নিওনেটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘অকাল জন্ম ও কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করায় প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ২৫ হাজার শিশু মৃত্যুবরণ করে।’

এই অকাল জন্ম হওয়া শিশুর মৃত্যুহার কমাতে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত যথাযথ নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তদারকি বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নাহরীন আখতার জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে অপরিণত শিশু জন্মহার গত কয়েক বছরে কমলেও এটি আশানুরূপ নয়। পরিবেশের তাপমাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা যারা শহরে থাকি তারা এসি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছি কিন্তু প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ সেই সুযোগ পাচ্ছে না। যতদূর সম্ভব সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। তীব্র গরমে বাইরে বের না হওয়া, বেশি পানি পান করা যাতে পানিশূন্যতা না হয়, ছায়াযুক্ত স্থানে থাকা ইত্যাদি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।’

আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী আহমেদ এহসানূর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য একটা নির্দিষ্ট হিটওয়েভ জোন চিহ্নিত করে সেখান থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে। এছাড়া হিট ওয়েভের সময় মানুষ হাসপাতালে যাওয়া কমে যায়। এক্ষেত্রে সমন্বিত গবেষণা করার মাধ্যমে এ বিষয়ে বিশদ তথ্য জানা যেতে পারে। হিট ওয়েভ নিয়ে সরকার যে গাইডলাইন প্রকাশ করেছে সেখানে মাতৃস্বাস্থ্য বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এই গাইডলাইনের সঠিক বাস্তবায়নে সবার উপকার হবে। আমার মতে আগামী এক দশকে আমাদের দেশের তাপমাত্রা আরও বাড়বে এবং ঘন ঘন তাপপ্রবাহ হবে। তাই আমাদের এ বিষয়টি মাথায় রেখে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’

বিভিন্ন দেশে এ সংক্রান্ত পলিসি আছে। সৌদি আরবে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। লন্ডনে তাপপ্রবাহ আসার এক সপ্তাহ আগে থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। আমাদের উচিত বৈশ্বিক প্রাকটিসগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিকল্পনা করা যেমন: ইমারজেন্সিতে পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা, চিকিৎসা কর্মীদের তীব্র গরমে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন আহমেদ এহসানূর রহমান।

এসআরএস/এমএমএআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।