বায়ুদূষণ রোধে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আইনের প্রয়োগ জরুরি

রায়হান আহমেদ
রায়হান আহমেদ রায়হান আহমেদ , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:২২ এএম, ১২ জানুয়ারি ২০২৫

শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এই সময়ে বিশ্বের অন্যতম দূষিত এলাকার তালিকায় উঠে আসে বাংলাদেশ। বায়ুদূষণ শুধু পরিবেশ নয়, মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেছেন, কার্যকর সমাধানের অভাব, সমন্বয়হীনতা এবং আইন বাস্তবায়নে দুর্বলতা বায়ুদূষণ সংকট মোকাবিলায় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বায়ুদূষণ রোধে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আইনের প্রয়োগ জরুরি।

জাগো নিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক রায়হান আহমেদ। আজ থাকছে সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব

আরও পড়ুন

জাগো নিউজ: শীতের সময় বাংলাদেশে বায়ুদূষণ কেন এত গুরুতর আকার ধারণ করে? এর মূল কারণগুলো কী?

আহমদ কামরুজ্জামান: বাংলাদেশের গত ১০ বছরের বায়ুর মানের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখতে পাই যে শীতকাল এলেই বিশেষ করে নভেম্বর থেকে মার্চ এই পাঁচ মাসে ৬০ ভাগের বেশি বায়ুদূষণ হয়ে থাকে। এই শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাত খুবই কম থাকে। অন্যদিকে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত দূষণের পরিমাণ কম থাকে। এ সময় বৃষ্টি হয়, তখন বৃষ্টির ওয়াশিং ইফেক্ট থাকে। তাই বায়ুদূষণ কম অনুভূত হয়। অনুভূত শব্দটা ব্যবহার করেছি, কারণ দেশে সারা বছরই বায়ুদূষণের সবগুলো উৎস সক্রিয় থাকে। ঢাকায় বায়ুদূষণের প্রধান উৎস ছয়টি। এই উৎসগুলো হলো রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজ, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বর্জ্য পোড়ানো, ইটের ভাটা ও শিল্পকারখানা, আন্তদেশীয় বায়ুদূষণ এবং গৃহস্থালিত রান্নার চুলা থেকে দূষণ। কিন্তু জুন-জুলাই মাসে এই উৎস থেকে সৃষ্টি হওয়া দূষিত বাতাস বৃষ্টির মাধ্যমে নিচে পতিত হয়। ওয়াশিং ইফেক্ট হয়।

শীতকালে যখন কুয়াশা পড়ে, তখন এই কুয়াশার সঙ্গে কেমিক্যাল ও ধুলাবালি মিলে এক ধরনের কেমিক্যাল কম্পোজিশন তৈরি করে, যাকে আমরা স্মোক (ধোঁয়া) বলে থাকি। এই স্মোক তৈরি হলে তখন এটা গাঢ় কুয়াশার মতো দেখা যায়। এগুলো দেখতে কুয়াশার মতো মনে হলেও এটা মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

জাগো নিউজ: চলতি শীত মৌসুমে ঘন কুয়াশার সঙ্গে একাধিক মাঝারি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ হতে পারে। কুয়াশা ও দূষণের সম্পর্ক কী? জানুয়ারিতে কি বরাবরের মতো দূষণ বেশি থাকবে?

আহমদ কামরুজ্জামান: আমাদের শহর অঞ্চলের দূষণের মধ্যে ব্ল্যাক কার্বন, ধুলাবালি ও কেমিক্যাল বেশি। শীতকালে যখন কুয়াশা পড়ে, তখন এই কুয়াশার সঙ্গে কেমিক্যাল ও ধুলাবালি মিলে এক ধরনের কেমিক্যাল কম্পোজিশন তৈরি করে, যাকে আমরা স্মোক (ধোঁয়া) বলে থাকি। এই স্মোক তৈরি হলে তখন এটা গাঢ় কুয়াশার মতো দেখা যায়। এগুলো দেখতে কুয়াশার মতো মনে হলেও এটা মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই ধরনের অবস্থা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে পরিলক্ষিত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে কুয়াশা আর ধোঁয়া মিলে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যার ফলে অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। সেই অনুযায়ী জানুয়ারিতেও একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন

 

জাগো নিউজ: শিল্পাঞ্চল, ইটভাটা ও যানবাহন থেকে নির্গত দূষণ কতটা দায়ী বলে আপনি মনে করেন?

আহমেদ কামরুজ্জামান: বাংলাদেশে আজ থেকে ১০ থেকে ১৫ বছর আগে শিল্পকারখানা এবং ইটের ভাটা থেকে প্রায় ৫৮ ভাগ দূষণ হতো। ইটের ভাটা ও শিল্পকারখানা থেকে যে দূষণ হতো, পরিমাণগত দিক থেকে তা কমেনি। তবে বায়ুদূষণের অন্যান্য উৎসের সঙ্গে যদি তুলনা করি রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, বর্জ্য পোড়ানোসহ যেসব কারণ রয়েছে, এগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বায়ুদূষণে ইটের ভাটার যে কন্ট্রিবিউশন ছিল সেটি আগের তুলনায় কমেছে।

সরকারি কাজে পোড়ানো ইটের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে ইটভাটা থেকে দূষণ কমে আসবে। আমাদের যে পরিবেশবান্ধব ব্লক ইট ব্যবহারের কথা ছিল, সেটিও ব্যবহার করা যেতে পারে।

জাগো নিউজ: ইটের ভাটা থেকে দূষণ কমানো যাচ্ছে না কেন? টেকসই বিকল্প প্রযুক্তির কী পরামর্শ দেবেন?

আহমেদ কামরুজ্জামান: সরকার বায়ুদূষণ রোধে যে নির্দেশিকা তৈরি করেছে সেখানে সরকারি কাজে পোড়ানো ইটের ব্যবহার ২০২৫ সালের মধ্যে শূন্যের ঘরে নিয়ে আসার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে এর সফলতা আমরা দেখতে পাইনি। আপনি দেখবেন, উৎপাদিত পোড়ানো ইটের প্রায় ৫০ ভাগ সরকারি কাজে ব্যবহার হয়। তাই সরকারি কাজে পোড়ানো ইটের ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। তাহলে ইটভাটা থেকে দূষণ কমে আসবে। আমাদের যে পরিবেশবান্ধব ব্লক ইট ব্যবহারের কথা ছিল, সেটিও ব্যবহার করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন

জাগো নিউজ: শহর ও গ্রামের বায়ুদূষণের চিত্র কি একই রকম, নাকি এখানে ভিন্নতা আছে?

আহমেদ কামরুজ্জামান: শহর ও গ্রামে বায়ুদূষণের পার্থক্য রয়েছে। শহরে দূষণের প্রায় সবগুলো উৎস সক্রিয় থাকে। বিশেষ করে নির্মাণ কাজ ও শিল্পকারখানা। সে অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে এই উৎসগুলো কম হয়। গ্রামে দূষণ কম হওয়ার কারণ দুটি। একটি হলো গ্রামে গাছপালা ও জলাধারের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। এছাড়া খোলা জায়গা থাকে অনেক। আরেকটি হলো গ্রামে শিল্পকারখানা ও নির্মাণ কাজ অনেক কম থাকে। সে কারণে গ্রামের অবস্থা তুলনামূলক ভালো রয়েছে।

জাগো নিউজ: যেমনটি বললেন, শুষ্ক মৌসুমে নির্মাণ কাজ বেশি হয়। অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি হয়। ফলে শহরে প্রচুর ধুলাবালি উড়ে। ধুলা বায়ুদূষণে কেমন প্রভাব ফেলে?

আহমেদ কামরুজ্জামান: যদি স্বাস্থ্যগত প্রভাব চিন্তা করি মাটি থেকে যে ধুলা তৈরি হয়, সেটি রাসায়নিক দূষণ। কার্বন ডাই অক্সাইড, ব্ল্যাক কার্বনের চেয়ে মাটির ধুলা কম স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত এই ধরনের ধুলা নিশ্বাসের সঙ্গে নেই। এই ধুলার সঙ্গে যখন কেমিক্যাল যুক্ত হয়, তখন ওই ধুলা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। কোনো দূষণকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। প্রতিটি দূষণ রোধে সমান গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

জাগো নিউজ: বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন কতটা কার্যকর ভূমিকা পালন করছে?

আহমেদ কামরুজ্জামান: বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা একদিনের কাজ নয়। একক কোনো প্রতিষ্ঠান এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। এখানে সবার সম্মিলিত প্রয়াস দরকার। পরিবেশ অধিদপ্তর হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে দূষণ নিয়ন্ত্রণে যে নির্দেশিকা তৈরি করেছে, সেখানে ২১টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার বিভিন্নভাবে দূষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ রয়েছে। দূষণের সঙ্গে জড়িত এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি এই সংস্থাগুলোকে যুক্ত করা হয়েছে। যেমন: সড়ক ও জনপথের যারা দূষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারা যেন যানবাহন থেকে যে ধোঁয়া হয়, সেটা নিয়ন্ত্রণ করে। একইভাবে আবার শিল্প কারখানা ও ইটের ভাটায় যে দূষণ হচ্ছে, সেটাকে শিল্প মন্ত্রণালয় তদারকি করবে। পরিবেশ অধিদপ্তর আইন প্রয়োগ করবে, সমন্বয় করবে। কারণ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সহজে দূষণ রোধে কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারবে।

আরও পড়ুন

সমন্বয়ের অভাবে শুধু বায়ুদূষণ নয়, এর অভাবে অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যাও সৃষ্টি হচ্ছে। আমি মনে করি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে এই সমন্বয়হীনতা বড় একটি চ্যালেঞ্জ।

জাগো নিউজ: বিভিন্ন মন্ত্রণালয় দূষণের সঙ্গে যুক্ত। আপনিও তেমনটি বললেন। বিগত বছরগুলো ধরে দেখে আসছি এদের মধ্যে সমন্বয় নেই। কেন এমন হচ্ছে?

আহমেদ কামরুজ্জামান: সমন্বয়ের অভাবে শুধু বায়ুদূষণ নয়, এর অভাবে অন্যান্য পরিবেশগত সমস্যাও সৃষ্টি হচ্ছে। আমি মনে করি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রে এই সমন্বয়হীনতা বড় একটি চ্যালেঞ্জ। আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি, একটা সংস্থা রাস্তায় কাজ শেষ করে যাওয়ার পর, সেখানে কার্পেটিং ছাড়া নির্মাণ সামগ্রী পড়ে থাকে, মাসাধিককাল। এরপর কার্পেটিং করলেও আরেকটি সংস্থা এসে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে। এটি সমন্বয়হীনতার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। যুগ যুগ ধরে এমনটি হয়ে আসছে। তাই আমার পরামর্শ, এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন তার সিটি গভর্ন্যান্সের আওতায় শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে পারে। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর শক্তিশালী আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এনফোর্স করে। তাহলে সমন্বয় করতে অন্যান্য মন্ত্রণালয় আগ্রহী হবে। একটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার মাধ্যমে অন্য মন্ত্রণালয়ের সফলতা বেড়ে যায়। এর সুফল জনগণ ভোগ করে।

আরও পড়ুন

জাগো নিউজ: পরিবেশ অধিদপ্তর বায়ুদূষণ রোধে তাদের আইন প্রয়োগ করতে পারছে না। বিশেষ করে সরকারি সংস্থাগুলোর প্রতি আইন প্রয়োগে বাধ্যবাধকতা নেই মনে হচ্ছে।

আহমেদ কামরুজ্জামান: আমরাও প্র্যাকটিক্যালি সেই অবস্থা লক্ষ্য করছি। কারণ ব্যক্তি উদ্যোগে যে নির্মাণ কাজ চলছে, সেখানে যেমন নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা হয় না। অন্যদিকে সরকারিভাবে কাজের ক্ষেত্রেও নির্মাণবিধি মেনে কাজ করতে দেখা যায় না। মেট্রো, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে সেখানেও নির্মাণসামগ্রী যত্রতত্র ফেলে রাখে। পরিবেশসম্মতভাবে রাখে না। এখানে আইনের বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতা রয়েছে। আমি মনে করি বায়ুদূষণ রোধে আইনের প্রয়োগটা সরকারি ও বেসরকারি দুই পর্যায়ে থাকতে হবে। নির্মাণবিধি মানাটা সবার জন্য জরুরি।

আরএএস/এমএমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।