নোয়াখালী-২

বিএনপির দুর্গে সিঁধ কাটতে আওয়ামী লীগে ভরসা ব্যবসায়ী প্রার্থী

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , ইকবাল হোসেন মজনু ইকবাল হোসেন মজনু নোয়াখালী ঘুরে
প্রকাশিত: ০৯:৪৮ এএম, ০৮ নভেম্বর ২০২২
মোরশেদ আলম, ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ, আতাউর রহমান মানিক ও জয়নুল আবদিন ফারুক

সংসদীয় আসন নোয়াখালী-২। খ্যাত বিএনপির দুর্গ হিসেবে। এলাকার অধিকাংশ ইউনিয়নে এখনো জনপ্রতিনিধি বিএনপির। এই আসন থেকে টানা পাঁচবারের এমপি জয়নুল আবদিন ফারুক। বিএনপি নির্বাচনবিমুখ থাকায় গত দুবার এমপি হয়েছে আওয়ামী লীগ থেকে। স্থানীয়দের দাবি, ক্ষমতায় থাকলেও আওয়ামী লীগ এখানে সমঝোতা করে চলে। তবে উপজেলা প্রশাসন কিংবা থানায় কিছুটা প্রভাব আছে দলটির।

বিএনপির এ দুর্গে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়াই করার মতো শক্তিশালী নেতা নেই আওয়ামী লীগে। যারা আছেন তারা ব্যবসায়ী বা পেশাজীবী। বিএনপিতে এর উল্টো। এখানে দলটির ডাকসাইটে নেতা আছেন, যারা নেতাকর্মীদের গতিবিধি বোঝেন এবং সে অনুযায়ী কাজ করেন। যে কারণে এলাকায় না থাকলেও তাদের অবস্থানই সুদৃঢ়।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ আসনে বরাবরই বিএনপির সমর্থক বেশি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গত এক দশকে যারা ছিলেন, তারাও এ অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেননি বা করার চেষ্টা করেননি। নিজের অবস্থান ঠিক রাখার জন্য বরং বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা করেছেন, যা দলটিকে করেছে আরও কোণঠাসা।

নোয়াখালী-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান এমপি মোরশেদ আলম। তিনি পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। বেঙ্গল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান। তিনিই ফের মনোনয়ন চাইবেন দলটির। এছাড়াও অর্থনীতিবিদ ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ ও আতাউর রহমান ভূইয়া মানিকও মনোনয়নের জন্য চেষ্টা করছেন বলে সূত্রের খবর। ড. জামাল দক্ষ ব্যাংকার, জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৮ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনও করেন এই আসনে। আতাউর রহমান মানিক ব্যবসায়ী, তমা গ্রুপের চেয়ারম্যান। পাশাপাশি জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। সেনবাগ উপজেলার চেয়ারম্যান ও তিনবারের উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আহমেদ চৌধুরীও প্রার্থী হতে চান।

বিপরীতে বিএনপির প্রার্থী দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক। পাঁচবারের এমপি ফারুকের কেন্দ্রীয় রাজনীতির পাশাপাশি এলাকায়ও নিয়ন্ত্রণ আছে বেশ ভালো। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী মফিজুর রহমানও এখানে দলটির মনোনয়ন চাইতে পারেন।

মনোনয়নের বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. জামাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি তো ২০০৮ এ নির্বাচন করেছি। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে বিক্রি হয়ে গেছে। এবার আবার চেষ্টা করছি, দেখা যাক।’

এলাকায় অবস্থান কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, নমিনেশন দেওয়া হলে যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি আছে। আশা করি আমি জয়ী হবো। বৃহত্তর নোয়াখালীতে এ ধরনের প্রার্থী খুব কম আছে। সব লাল্লু-পান্ডুর গোষ্ঠী, এগুলো ভবিষ্যৎ রাজনীতি বা দেশের জন্য কোনো অবদান রাখতে পারছে না। চাঁদাবাজি ছাড়া আর কিছু নেই। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য লোক লাগবে। দুর্নীতি, জালিয়াতি, অর্থপাচার এগুলো বন্ধ করতে হলে আমাদের প্রতিনিধিত্বে আসতে হবে।’

‘এখন যত প্রার্থী আছে, আপনি প্রোফাইল নেন, কজন সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা রাখেন? এমপি তো এত সহজ বিষয় নয়। রুলস অব বিজনেস, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির অপারেশনস, পাবলিক অ্যাকাউন্টস, ফাইন্যান্স কমিটি ও ডিফেন্স কমিটিতে প্রতিনিধিত্ব করে সংসদীয় ব্যবস্থা চালানোর জন্য তো লোক দরকার। ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হওয়ার যোগ্যতা নেই, হয়ে বসেছেন এমপি। জীবনে কোনোদিন স্কুলে যাননি, তিনি এমপি। এরা কী করবেন? চুরি ছাড়া আর অন্য কী করবেন?’

‘আমাদের রাজনীতি না করলেও কিছু যায় আসে না। কিন্তু দেশের জন্য আমাদের অবদান থাকা উচিত। ক্লাস সিক্স থেকে পিএইচডি পর্যন্ত কোনো বেতন দিতে হয়নি। দেশ তো আমার পেছনে অনেক বিনিয়োগ করেছে। এখন বিনিময়ে আমরা দেশের জন্য কিছু করতে চাই।’ যোগ করেন এই অর্থনীতিবিদ।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ‘আমি বিএনপির একজন তৃণমূল পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মী। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। একজন যোদ্ধা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে লেখাপড়া শেষ করে ব্যবসায় জড়িত হয়েছিলাম। দীর্ঘদিন রাজনৈতিক নীরবতার পর ১৯৮৮ সালের শেষ দিকে জিয়াউর রহমানের কার্যকলাপ ও খালেদা জিয়ার আপসহীনতা দেখে এই দলে যোগ দেই। সেই থেকে এখনো বিএনপির কর্মী।

‘আমাকে ধানের শীষে পাঁচবার মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, নির্বাচিত হয়েছি। আমার কোনো গুণ নেই। গুণ হলো ধানের শীষের, জিয়া ও খালেদা জিয়ার। এখন রাজনীতি করি তারেক রহমানের। তার নির্দেশে সারাদেশে তৃণমূল পর্যায়ে আমরা সংগঠন সুসংগঠিত করে যাচ্ছি। মাসে ১৫ দিন এলাকায় থাকি। বিএনপিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করি। নিজের কাজ ছাড়া এলাকা ছেড়ে যাইনি। আন্দোলন-সংগ্রামে ঢাকাসহ সারাদেশের যোগাযোগ রক্ষা করি। আমি মনে করি, এখনো জনগণের পুরো সেবার কাজ শেষ করতে পারিনি, চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

সেনবাগ উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক অবস্থা অগোছালো, গ্রুপিং অনেক বেশি। বহুত গ্রুপ। মোরশেদ আলম সাহেবের অবস্থা মোটামুটি ভালো। এলাকার জন্য কিছু কাজ করেছেন। তবে প্রকৃত ভোট হলে এখানে নৌকার জয় নিয়ে সন্দেহ আছে।’

সেনবাগ উপজেলার চেয়ারম্যান ও তিনবারের উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আহমেদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, ত্যাগী এই ধরনের প্রার্থীকে যদি মনোনয়ন দেয় তাহলে আওয়ামী লীগ এখানে জয়লাভ করবে। তবে হাইব্রিড হলে হবে না। আমিও এখানে প্রার্থী হওয়ার আশা করছি।

এলাকার সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে তিনি বলেন, এখানে আমাদের সাংগঠনিক শক্তি খারাপ না। গ্রুপ দুটো। আমাদের এমপি সাহেব একদিকে, আমরা যারা ত্যাগী, সিনিয়র আমরা সবাই দলের পক্ষে একদিকে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এমপি সাহেব পয়সাওয়ালা লোক, আর সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত। আবার ওনার অনেক বয়স হয়েছে, বাড়িও সেনবাগ না। যে কারণে উনি অনেক সময় নেতাকর্মী চিনতে পারেন না। লোকাল একটা প্রার্থীর যে শক্তি, বাইরের লোকের সেই শক্তি নেই। সরকার যথেষ্ট উন্নয়ন করছে, এজন্য আমার বিশ্বাস স্থানীয় কাউকে প্রার্থী দিলে নেতাকর্মী এবং জনগণ আমাদের পক্ষেই থাকবে।

এলাকার বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা জানতে কথা হয় স্থানীয়দের সঙ্গে। সেনবাগ উপজেলার ৬ নম্বর কাবিলপুর ইউনিয়নের মুন্সিরহাট বাজারে মা টেলিকমের মো. জসিম বলেন, এমপি এলাকায় আসেন মাঝে মধ্যে। অনুষ্ঠানে যোগ দেন। মানুষের খবর নেন।

চা দোকানি খোকন বলেন, দেশ স্বাধীনের পর এখানে মেম্বারও হয়নি আওয়ামী লীগ থেকে। ভোট হলে এমপি হবেন জয়নুল আবদিন ফারুক। তিনিই গত পাঁচবারের এমপি। সব নিয়ন্ত্রণ এখনো তার। এখানে আওয়ামী লীগ নেই। তবে পুলিশের হাতে সব।

রিকশাচালক জসিম বলেন, এখন তো অবস্থা খারাপ, টাকা যেদিকে ভোট সেদিকে। কিন্তু প্রকৃত ভোট হলে এমন পরিবেশ থাকবে না।

সেনবাগ উপজেলা ও সোনাইমুড়ি উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন (বারগাঁও, নাটেশ্বর ও অম্বরনগর) নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের ২৬৯ নম্বর আসন নোয়াখালী-২। এখানে মোট ভোটার ২ লাখ ৭৩ হাজার ৭৮৮। পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩৮ হাজার ৪২ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭৪৬। এ আসনে জয়নুল আবদিন ফারুক পাঁচবারের এমপি। গত দুবার বিএনপি ছেড়ে দেওয়ায় ব্যবসায়ী মোরশেদ আলম এমপি হয়েছেন।

ভোটের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এখানকার বেশিরভাগ জনসমর্থন বিএনপির পক্ষে। সব সময় পাস করেও তারা। এজন্য গত কয়েক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কৌশলে সরাসরি দলীয় নেতা না দিয়ে পেশাজীবী বা ব্যবসায়ীদের দিয়েছে। কারণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের একটা সম্পর্ক থাকে। পাশাপাশি তারা এলাকার মানুষের জন্য কাজ করেন।

এসইউজে/এএসএ/জিকেএস

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।