লক্ষ্মীপুর-৩

বিএনপির ‘বাধা’ জামায়াত, আওয়ামী লীগে বিভাজন

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , কাজল কায়েস কাজল কায়েস
প্রকাশিত: ১২:২৯ পিএম, ১৩ ডিসেম্বর ২০২২

এক সময়ের সন্ত্রাসের জনপদ লক্ষ্মীপুর-৩। ২০-২২টি সন্ত্রাসী বাহিনী ছিল এখানে। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে যে কাউকে দিন-দুপুরে হত্যার ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। খুন, রাহাজানি ও ডাকাতির এই জনপদে এখন শান্তি বিরাজ করছে। উপকূলে সরকারের উন্নয়নও চোখে পড়ার মতো। পাশাপাশি বিরোধী মতকে শক্ত হাতে দমনেরও নজির আছে। যে কারণে এখানকার উন্নয়ন ছাপিয়ে ক্ষোভও আছে অনেকের। ভোটের হিসাবে এখানে বরাবরই এগিয়ে বিএনপি। গত দুবার আওয়ামী লীগ জয়ী হওয়ায় হিসাব কিছুটা পাল্টেছে। তবে দলের বিভাজন ফেলতে পারে বিপাকে। জামায়াত এখানে দুই দলের জন্যই ফ্যাক্ট।

সরেজিমনে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এলাকাটি বিএনপি অধ্যুষিত। আওয়ামী লীগ টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকায় সরকারের নেতিবাচক বিষয়গুলো পুঁজি করে বিরোধী মনোভাব আরও পোক্ত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা নিজেদের করে নিতে পারেননি এলাকাটি। স্থানীয় এমপি এখানে অধরা। বিরোধীরা আছে শক্ত অবস্থানে।

এখানে আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি শাজাহান কামাল। তিনি অসুস্থতার কারণে এলাকায় তেমন সময় দিতে পারেন না। তারপরও তিনিই এখানে ফের আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। বর্তমান এমপি ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু, সজীব করপোরেশনের চেয়ারম্যান এম এ হাশেম, ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ সাত্তার, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য খোকন চন্দ্র পাল এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইবেন বলে জানান স্থানীয় নেতারা।

মনোনয়ন ও ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগে আছে বিভাজন। এখানে ‘পুরোনো আওয়ামী লীগ’বা গডফাদারখ্যাত আবু তাহের ছিটকে পড়েছেন আওয়ামী লীগ থেকে। তার বড় ছেলে যুবলীগের আহ্বায়ক এ কে এম সালাহউদ্দিন টিপু সদর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র নির্বাচন করায় তাকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিবারের অন্য সদস্যরাও এখন দলে নেই সক্রিয়। মোটামুটি বলা যায়, লক্ষ্মীপুর পৌরসভার দুবারের সাবেক মেয়র আবু তাহের গ্রুপ এখন একঘরে। উত্থান হয়েছে নয়া গ্রুপের। পাশাপাশি বর্তমান এমপির প্রতি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও নাখোশ। যে কারণে আরও একটি বিকল্প গ্রুপ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে প্রার্থিতা নিয়ে বর্তমান এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির মধ্যকার গ্রুপিং আছে ভেতরে ভেতরে।

আবু তাহেরের ছেলে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম সালাহউদ্দিন টিপু জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা তো এখন আর আওয়ামী লীগ করি না। আমাদের স্বতন্ত্র বানিয়ে বসিয়ে রাখছে ঘরের ভেতর। আমাদের আওয়ামী লীগ করতে দেয় না, আর নাকি দেবেও না।’

প্রার্থীদের কী অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিপুল ভোটে ঠগবো (হারবে)। প্রার্থী তো আছে না আছে, বোঝাও যায় না। যিনি এমপি, উনি জীবিত না মৃত এটা কেউ বুঝতেও পারেন না, জানেনও না। পূজা-পার্বনে, ঈদে চান্দেও এলাকায় আসেন না।’

এদিক থেকে শক্ত অবস্থানে বিএনপি। একক প্রার্থী দলটির প্রচার সম্পাদক ও সাবেক এমপি শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। জামায়াতের প্রার্থী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের সেক্রেটারি ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম। বিএনপি-জামায়াত জোট না থাকলে আওয়ামী লীগ সুবিধা পাবে। কারণ, বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতেরও ভালো অবস্থান আছে এখানে। দু-একটি সংসদ নির্বাচনে তারা ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে। জোট হলে বিএনপি ও জামায়াতের ভোট এক হয়ে যাবে। এতে এগিয়ে থাকবে তারা। তবে জোট না হলে বিএনপির ভোট কিছুটা কমবে। যার সুফল পাবে আওয়ামী লীগ। সে হিসেবে বলা যায় বিএনপির জয়ে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে জামায়াত।

আওয়ামী লীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্যেও মেলে এই হিসাব।

তারা বলছেন, ‘এখানে বিএনপি ৭০ শতাংশ ভোট পাবে, আওয়ামী লীগ ৩০ শতাংশে সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে।’

সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রহমত উল্যাহ বিপ্লব জাগো নিউজকে বলেন, বরাবরই লক্ষ্মীপুরে আওয়ামীবিরোধী লোক বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকারবিরোধী জাতীয় সেন্টিমেন্ট। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এখানে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে দলে। তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে জেলা নেতাদের সম্পর্ক নেই। এমপি সাহেব অসুস্থ, যার কারণে এলাকায় অনুপস্থিত। নেতাকর্মীরাও অভিভাবকহীন।

‘উন্নয়নের সঙ্গে ভোটের সম্পর্ক নেই, গণজোয়ারেরও সম্পর্ক নেই। এটা একটা উপাদান মাত্র। ভোটের ক্ষেত্রে প্রার্থীর আচরণ, গ্রহণযোগ্যতা, এলাকা সম্পৃক্ততা, দলের কর্মসূচি এবং দেশ ও জাতীয় স্বার্থের বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। এখানে ভূমি দখল, নিয়োগ বাণিজ্য, মনোনয়ন বাণিজ্য, পদ বাণিজ্য ও জনআকাঙ্ক্ষার বিপরীতে কাজ করে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হচ্ছে।’মনে করেন এই জনপ্রতিনিধি।

উত্তর হামছাদি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জেলা শ্রমিক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম বলেন, নৌকার ভোট বাড়ছে কিছুটা। মাঠে নেতাকর্মীরা আরও স্বচ্ছ থাকলে এবং নেত্রীকে ফলো করে যদি কাজ করে আরও জনসমর্থন বাড়ার কথা।

নির্বাচনী এলাকার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের সুতার গোফটা মধ্যবাজারে চায়ের দোকানের আড্ডায় কথা হয় স্থানীয়দের সঙ্গে। তাদের একজন আশরাফ উদ্দিন বলেন, এখানে বিএনপির ভোট বেশি। বিএনপির এ্যানি জনপ্রিয়। আওয়ামী লীগে গ্রুপিং আছে। এই ইউনিয়নেও (ভবানীগঞ্জ ইউনিয়ন) চেয়ারম্যান হয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী। আওয়ামী লীগের লোকই, কিন্তু স্বতন্ত্র নির্বাচন করে চেয়ারম্যান হয়েছেন। নৌকা যাকে দিয়েছে, তাকে সবাই মিলে হারাতে কাজ করেছে।

লিটন নামে একজন বলেন, ‘ভোট হয়ে লাভ কী? আমরা তো ভোট দিতে পারি না।’

বিএনপির মনোযোগ আন্দোলনে
বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি জাগো নিউজকে বলেন, আমি প্রার্থী কি না সেটা বিএনপি ঠিক করবে, দল মনোনয়ন দেবে। এখন আমরা নির্বাচন নিয়ে কথা বলছি না, আন্দোলন নিয়ে আছি। আমরা দল হিসেবে মাঠে আন্দোলন সংগ্রাম করছি।

তিনি বলেন, দেশে একটা অবৈধ শাসক ক্ষমতা দখল করে আছে। অনির্বাচিত সরকার আছে। দিনের ভোট রাতে করেছে। অবৈধভাবে তারা আসছে, গণতান্ত্রিক পন্থায় নেই। সুতরাং, এই সরকার অবিলম্বে পদত্যাগ করে সংসদ ভেঙে দেয় এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যেন নির্বাচনের ব্যবস্থা হয়, সেজন্য আমরা আন্দোলন করছি। ওটাই আমাদের টার্গেট। টার্গেটে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে আমরা কথা বলবো না।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সৈয়দ শামসুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, পুরো লক্ষ্মীপুর বিএনপির ঘাঁটি। বিএনপি জোট ৮০ শতাংশ, আওয়ামী লীগ ২০ শতাংশ। আওয়ামী লীগের অধীনে ভোট হলে বিএনপি এক সিটও পাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলে আওয়ামী লীগ একটা সিটও পাবে না।

তিনি বলেন, লক্ষ্মীপুর-৩ আসনে বিএনপির একক প্রার্থী হবেন শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। এটা নিয়ে কোনো সংশয় নেই।

বিএনপির জেলা কমিটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলেও জানা যায়, তারা এখন ভোট নিয়ে ভাবছেন না। ভোটের পরিবেশ তৈরির আন্দোলনে আছেন।

ভোটের সমীকরণ

ভোটের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, লক্ষ্মীপুর-৩ আসনটি গত দুবার ছাড়া নব্বইয়ের দশক থেকে বিএনপির দখলে। ’৯৬ ও ২০০৮-এ আওয়ামী লীগের জোয়ারের সময়ও বিপুল ভোটে বিএনপি প্রার্থী জয় পায়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বিএনপির ভোট বর্জনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ কে এম শাহজাহান কামাল নির্বাচিত হন।

নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, ৯ম সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) বিএনপির শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি ১ লাখ ৯ হাজার ৬৩১ ভোটে জয় পান। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মো. আবুল হাসেম পান ৮২ হাজার ৫০ ভোট।

৮ম সংসদ নির্বাচনে (২০০১) বিএনপির শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি ৯৫ হাজার ২১৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের কাজী মো. ইকবাল হোসাইন পান ৪১ হাজার ২৩৫ ভোট।

৭ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯৬) বিএনপির খাইরুল এনাম ৪২ হাজার ২৩২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের এ কে এম শাহজাহান কামাল পান ২৭ হাজার ৭৮৭ ভোট।

৫ম সংসদ নির্বাচনে (১৯৯১) বিএনপির খাইরুল এনাম ২৬ হাজার ৯০৮ ভোট পেয়ে জয় পান। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামীর মো. সফিক উল্লাহ পান ১৯ হাজার ১৩২ ভোট।

এসইউজে/এএসএ/জেআইএম

টাইমলাইন  

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।