হকিতে সার্কাস চলছেই

রহস্যজনক কারণে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তদন্ত ধামাচাপা!

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০২:০৬ পিএম, ২২ আগস্ট ২০২৫

বাংলাদেশের হকি মানেই সার্কাস। বিশেষ করে ঘরোয়া প্রতিযোগিতার সময় এই শব্দটি বেশি উচ্চারিত হয়। যুগের পর যুগ এই ফেডারেশনে হয়ে আসছে অদ্ভূত সব কাণ্ড। যার সর্বশেষটি হলো, বয়স বেশি হওয়ার কারণ দেখিয়ে দেশসেরা ফরোয়ার্ড রাসেল মাহমুদ জিমিকে জাতীয় দলের বাইরে রাখা।

এ বছর এপ্রিলে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় অনুষ্ঠিত এএইচএফ কাপের দল গঠনের আগে নজিরবিহীন এমন আইন করে জিমিকে বাদ দিয়েছিল বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের বর্তমান কমিটি।

এএইচএফ কাপের সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপে খেলার যোগ্যতা হারিয়েছিল বাংলাদেশ। যদিও পাকিস্তান নাম প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশ আগামী ২৯ আগস্ট ভারতে শুরু হতে যাওয়া এশিয়া কাপে খেলবে। সেটি কেবলই এশিয়ান হকি ফেডারেশনের দয়া। যোগ্যতা অর্জন করতে না পারার ব্যর্থতায় তখন হকিই ছিল দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।

জিমিকে বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় তীব্র সমালোচনা হয়েছিল ক্রীড়াঙ্গনে। এমনকি বিষয়টি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চেয়ারম্যান, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার কানেও গিয়েছিল। তিনি বিষয়টি দেখবেন বললেও জিমিকে আর দলে ফেরানো হয়নি। জাতীয় দল ইন্দোনেশিয়া থেকে ফিরে আসে শূন্য হাতে।

শুধু জিমি ছিলেন না বলেই যে বাংলাদেশ এশিয়ান কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি বিষয়টা তেমনও না। এএইচএফ কাপে ব্যর্থতার পেছনে আরও রহস্য ছিল বলে ওই সময় আভাস দিয়েছিলেন জাতীয় দলের কয়েকজন খেলোয়াড়। প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপে খেলতে না পারার কারণ নতুন করে সামনে এসেছে দুইদিন আগে এশিয়া কাপের দল ঘোষণার পর।

এএইচএফ কাপের অধিনায়ক পুস্কর খিসা মিমোসহ ওই দলের ৩ খেলোয়াড় বাদ দিয়ে এশিয়া কাপের স্কোয়াড ঘোষণা করেছে ফেডারেশন। বাদ পড়া খেলোয়াড়েরা কারণ জানতে গিয়ে হেনস্থা হয়েছেন ফেডারেশনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছে। এমনকি এক খেলোয়াড়কে অকথ্য ভাষায় গালি দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে যুগ্ম-সম্পাদক কাজী আবু জাফর তপনের বিরুদ্ধে। এই ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় দেশের হকি। বাদ পড়ার পর অপমান অপদস্থ হওয়া খেলোয়াড় ওই কর্মকর্তার পদত্যাগও দাবি করেছেন।

গত এপ্রিলে হয়েছে এএইচএফ কাপ। জিমিকে না নেওয়া এবং ওই টুর্নামেন্টে চরম ব্যর্থ হওয়ার কারণ খতিয়ে দেখতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিল। ৪ মে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তৎকালীন পরিচালক (ক্রীড়া) মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরকে আহবায়ক করে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের তৎকালীন সহকারী পরিচাকি (ক্রীড়া) সাজিয়া আফরিন ও সদস্য পরিষদের চেয়ারম্যানের একান্ত সচিব সাইফুল ইসলাম।

সাড়ে তিন মাস কেটে গেলেও আলোর মুখ দেখেনি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন। ওই তদন্তের খবর কী?

শুক্রবার এমন প্রশ্ন করা হলে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্বাহী পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলাম। তবে এখনো প্রতিবেদন পাইনি।’

প্রতিবেদন কি তৈরি হয়েছে? উত্তরে মো: আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। যাদেরকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তারাই ভালো বলতে পারবেন। প্রতিবেদন জমা পড়েনি এতটুকু্ই বলতে পারবো।’

কমিটির সদস্য সচিব সাজিয়া আফরিন ক্রীড়া শাখা থেকে এখন প্রশাসন শাখায় আছেন। তদন্ত কমিটির সর্বশেষ আপডেট জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। আমি ক্রীড়া শাখা ছেড়ে আসার সময়ই প্রতিবেদনে স্বাক্ষর করে দিয়েছিলাম।’

কমিটির সদস্য সচিব বলছেন, প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে নির্বাহী পরিচালকের কাছে। আর নির্বাহী পরিচালক বলছেন তিনি প্রতিবেদন পাননি। তাহলে কোথায় গেল এই প্রতিবেদন?

বিষয়টি জানতে কমিটির প্রধান পরিচালক (বর্তমানে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মোহাম্মদ হুমায়ুন কবিরকে কয়েকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রমতে, রহস্যজনক কারণে হকির তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দেওয়া হতে পারে। ওই সূত্রের দাবি, তদন্ত কমিটি গঠনের পরই এর যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তদন্ত যাতে করা না হয়, সেই চাপও নাকি ছিল বিভিন্ন পর্যায় থেকে।

তবে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্বাহী পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমার কাছে কোনো চাপ ছিল না। আর সঠিক কোনো কাজে বাধা দিতে আমাকে চাপ দিয়েও লাভ নেই। অন্য কারো ওপর কোনো ধরনের চাপ ছিল কিনা, সেটা আমি জানি না। আপনি সংশ্লিষ্টদের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন।’

যে বিষয়টি নিয়ে অবহিত স্বয়ং ক্রীড়া উপদেষ্টা সেই বিষয়ের তদন্ত প্রতিবেদন কেন জমা পড়লো না ক্রীড়াঙ্গনে সেটাই বড় প্রশ্ন। গেল ৪ মে গঠিত তদন্ত কমিটিকে অবশ্য সময় বেঁধে দেওয়া ছিল না। তবে একটি বিষয়ে তদন্ত করতে সাড়ে তিন মাসেরও বেশি সময় চলে যাবে?

হকিতে একের পর এক যে ঘটনা ঘটে, তাতে ওই প্রতিবেদন জমার আগে আরেকটি তদন্ত কমিটিও গঠন প্রয়োজন হতে পারে।

আজ শুক্রবার বিকেলে এএইচএফ কাপের অধিনায়ক পুুস্কর খিসা মিমোসহ তিন সিনিয়র খেলোয়াড় যুগ্ম-সম্পাদক তপনের পদত্যাগ দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করবেন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ গঠিত হকির অ্যাডহক কমিটি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে কিনা, সে বিষয়ে মূল্যায়নের সময় এসেছে দেশের খেলাধুলার অন্যতম এই অভিভাবক প্রতিষ্ঠানটির।

সময় মতো এএইচএফ কাপের ব্যর্থতার কারণ খতিয়ে দেখার জন্য তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা পড়লে হয়তো আজকে নতুন করে এই অবস্থা তৈরি হতো না। ফিটনেস না থাকলে, পারফরম্যান্স না থাকলে জাতীয় দল থেকে যে কোনো খেলোয়াড়কেই বিদায় নিতে হবে। তবে সেই বিদায় নেওয়া যদি হয় কোনো কোনো সংগঠকের আক্রোশের ফল, তাহলে সেই কারণ খতিয়ে দেখাই উচিত।

ক্রীড়া উপদেষ্টার নির্দেশে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সেই উদ্যোগ দ্রুতই নিয়েছিল। তবে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা সময়মতো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি বা দেয়নি। ফল হকিতে শুরু হয়েছে আরেকটি সার্কাস। এবার উঠলো খেলোয়াড় কর্তৃক কর্মকর্তার পদত্যাগ দাবি।

আরআই/এমএইচ/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।