অপ্রচলিত খেলা বেসবল-সফটবল চলছে নানা সঙ্কটে

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম রফিকুল ইসলাম , বিশেষ সংবাদদাতা
প্রকাশিত: ০৩:০৭ পিএম, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) থেকে বাংলাদেশ জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশন। মাঝে ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন আরও ৫১টি। দেশে ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের তালিকাটা বেশ লম্বাই। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এখন দেশের সবচেয়ে ধনী ফেডারেশন। এরপরই ফুটবল।

বাকি ফেডারেশনগুলোর মধ্যে বেশিরভাগেরই বছর চলে নানা কষ্টে। অর্থ সংকট, ভেন্যু সংকটের মধ্যেই চলে তাদের কার্যক্রম। ছোট এই ফেডারেশনগুলোর ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ অবস্থা।

ছোট ছোট ফেডারেশনগুলো কিভাবে তাদের কার্যক্রম চালায় তা নিয়ে এই ধারাবাহিক প্রতিবেদন। আজকের খেলা বেসবল-সফটবল।

বেসবল-সফটবল খেলাটির প্রচলন শুরু যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়। দুই দেশেই এই খেলার পেশাদার মেজর লিগ হয়ে থাকে। বর্তমানে বেসবল-সফটবলে দাপট দেখাচ্ছে জাপান। অলিম্পিকে স্বর্ণও জিতেছে এশিয়ার অন্যতম ধন্যাঢ্য এই দেশটি।

বেসবল-সফটবল অনেকটা ক্রিকেটের মত ব্যাট ও বলের খেলা। প্রতি দলে ৯ জন করে খেলোয়াড় থাকেন। টস জয়ী দল প্রথম ব্যাট বা ফিল্ডিং বেছে নেয়। ব্যাটিং দলের খেলোয়াড় ফিল্ডিং দলের পিচারের বল মোকাবিলা করে। তারপর বিভিন্নভাবে রান সংগ্রহ করে। ফিল্ডিং দল তিন জন ব্যাটারকে আউট করতে পারলে একটি ইনিংসের সমাপ্তি হয়। এভাবে ৯ ইনিংসে হয়ে থাকে এই খেলাটি।

Baseball

ব্যাটারের পেছনে ক্রিকেটের উইকেটরক্ষকের মতো একজন ক্যাচারও থাকেন। যিনি বল করেন তাকে বলা হয় পিচার। অন্যরা ফিল্ডার। ক্যাচ আউট, স্ট্রাইক আউট, ফোর্স আউট ও রানআউট- এই চার ধরনের আউট আছে বেসবলে।

পিচারের করা বল মেরে ক্রিকেটের রান নেওয়ার মতো দৌড় শুরু করেন ব্যাটার। তিন কোনা মাঠে চারটি বেস থাকে। ফিল্ডার বল ধরার আগে ব্যাটার চারটি বেস ঘুরে আসতে পারলে ১ পয়েন্ট বা রান পেয়ে থাকেন। পরপর চারটি বল ঠিকমতো মারতে না পারলে আউট হয়ে যাবেন। তখন আরেকজন ব্যাট করবেন। এভাবে তিনজন আউট হলে এবং এক ইনিংস শেষ হবে ফিল্ডিংয়ের দল ব্যাটিংয়ে আসবে, ব্যাটিং দল ফিল্ডিংয়ে যাবে।

বেসবল ও সফটবলের খেলার ধরন ও নিয়ম এক হলেও পার্থক্য কেবল ব্যাট ও বলে। সফটবলটি হয়ে থাকে একটু বড় এবং ব্যাট একটু চিকন। সফটবল সাধারণত মেয়েরা খেলে থাকে। আউট, পয়েন্টসহ অন্য নিয়মগুলো বেসবলের মতোই। বেসবল-সফটবল খেলায় আম্পায়ার থাকেন চারজন। এ ছাড়া বেসবলে পিচার যেভাবে বল করে থাকেন, সফটবলে সেভাবে করা হয় না। সফটবলে বল করার ধরণ একটু ভিন্ন।

Baseball

বাংলাদেশে এই খেলার প্রচলন শুরু ২০০৬ সালে। ওই বছরই গঠিত হয় বাংলাদেশ বেসবল অ্যাসোসিয়েশনে। পরে যোগ হয় সফটবল। ২০০৯ সালে অ্যাসোসিয়েশনটি জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের স্বীকৃতি পায়। অলিম্পিক ডিসিপ্লিন হিসেবে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন খেলাটিকে অনুমোদন দেয় ২০১৯ সালে। ওই বছরই বাংলাদেশ বেসবল-সফটবল অ্যাসোসিয়েশন সদস্য হয় ওয়ার্ল্ড বেসবল-সফটবল কনফেডারেশন (ডব্লিউবিএসসি) এবং বেসবল ফেডারেশন অব এশিয়ার (বিএফএ)।

এই অ্যাসোসিয়েশনটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সভাপতির দায়িত্বে আছেন আলহাজ্ব মো. সোলায়মান ও সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লিটন। এই কয় বছরে চারবার অ্যাডহক কমিটি পূনর্গঠণ হলেও বদলায়নি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। দেশে কম জনপ্রিয় বলে খেলাটি পরিচালনা করার অর্থ সংগ্রহে ঘাম ঝরাতে হয় অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের।

Baseball

অনুমোদন দেওয়ার পর থেকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এই অ্যাসোসিয়েশনকে বছরে ৭০ হাজার টাকা অনুদান দেয়। তাও চার কিস্তিতে। এই অর্থে তাদের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না।

পরিচিত ও প্রচলিত খেলা নয় বলে স্পন্সরও পাওয়া যায় না। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপগুলো আয়োজন হয়ে থাকে ওয়ালটনের সৌজন্যে। প্রথম দিকে কয়েকটি টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছিল সভাপতির ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায়। এরপর থেকে বেসবল-সফটবলের একমাত্র স্পন্সর হিসেবে আছে ওয়ালটন।

অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লিটন জানালেন, ‘অর্থের অভাবে আমাদের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপগুলো ছোটখাটো আয়োজনের মধ্যে দিয়ে করতে হয়। খেলা প্রচলন বলতে গেলে ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ঢাকা জেলা ও সাভার দুই নামে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেয়। তবে বেশি খেলোয়াড় পুলিশ বাহিনীতে। এরপর আনসারে। ঢাকার বাইরে সিরাজগঞ্জসহ কয়েকটি জেলা অংশ নেয় জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে। আর্থিক সাশ্রয়ের জন্য ক্লাবের অংশগ্রহণ বেশি রাখা হয়। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে আরো বেশি দল আনা সম্ভব; কিন্তু টাকা কম বলে আমাদের টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হয় সীমিত আকারে।’

বেসবল-সফটবল অনেক ব্যয়বহুল খেলা। একটা গ্লাভস ও একটি ব্যাটের মূল্য সর্বনিম্ন ১৫ হাজার টাকা। বলের দাম ৬ থেকে ৮ শত টাকা। বাংলাদেশে খেলা যখন শুরু হয় তখন স্থানীয়ভাবে বানানো কাঠের ব্যাট ব্যবহার করা হতো। যা অত্যন্ত ভারি ছিল। এখন কিছু সরঞ্জাম অ্যাসোসিয়েশন জাপান থেকে অনুদান পেয়ে থাকে, কিছু সরঞ্জাম অ্যাসোসিয়েশন ক্রয় করে।

ওয়ার্ল্ড বেসবল-সফটবল কনফেডারেশনের সদস্য হওয়ায় বাংলাদেশ দুটি আন্তর্জাতিক আসরে অংশও নিয়েছে। ২০১৯ সালে ভারতের গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল আমন্ত্রণমূলক একটি টুর্নামেন্ট। সেখানে বাংলাদেশ অভিষেক ম্যাচে ভারতকে হারিয়ে চমক দেখিয়েছিল। যদিও পরে নেপালের কাছে হেরেছিল বড় ব্যবধানে। এই টুর্নামেন্টে তৃতীয় স্থানের ট্রফি নিয়ে দেশে ফেরে খেলোয়াড়রা। একজন খেলোয়াড় ফিল্ডিংয়ে সেরা পুরস্কারও পায়।

Baseball

২০১৯ সালে বাংলাদেশ খেলতে গিয়েছিল শ্রীলংকায়। সেখানে অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, ইরান ও নেপাল। এশিয়ান ফেডারেশনের অধীনে শ্রীলংকা বেসবল ফেডারেশন আয়োজিত ৬ জাতির ওয়েস্ট এশিয়া কাপে বাংলাদেশ পঞ্চম হয়েছিল।

এক বছর আগে যে নেপালের কাছে বড় ব্যবধানে হেরেছিল বাংলাদেশ, কলম্বোয় সেই নেপালকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে নিয়েছিল প্রতিশোধ। ৩ ম্যাচ খেলে জয় পেয়েছিল একটিতে। ৬ দেশের মধ্যে পঞ্চম হয়ে ফিরেছিল লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। বিশ্ব র‌্যাংকিয়ে এখন আছে ৮৫ দেশ। বাংলাদেশের অবস্থান ৭৬ নম্বরে। এক নম্বরে জাপান।

কোনো টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে গেলে একটি স্পন্সরের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হয় বেসবল-সফটবল অ্যাসোসিয়েশনকে। বছরে তাদের খরচ হয় ১০ লাখ টাকার মতো। টাকার অভাবে টুর্নামেন্টগুলো ছোট করে আয়োজন করে। অর্থ ও ভেন্যু সংকটের কারণে লিগ আয়োজনের পথে এখনো হাঁটতেই পারেনি অ্যাসোসিয়েশনটি।

এ বছর পুরুষদের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন হলেও গত বছর অ্যাসোসিয়েশনটি তাদের ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন করতে পারেনি। করোনার ভয়বহতা ও স্পন্সর সংকটে একটি বছর কোন খেলা আয়োজন না করেই কাটিয়ে দিতে হয়েছে বেসবল-সফটবলকে।

পরবর্তী সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমস হবে পাকিস্তানে। দক্ষিণ এশিয়ায় এ খেলায় বেশ শক্তিশালী পাকিস্তান। তাই তারা আগামী এসএ গেমসে বেসবল-সফটবল অন্তর্ভূক্ত করেছে।

অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জানালেন, ‘আমরাও বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনে চিঠি দিয়েছি যাতে এসএ গেমসে এই খেলাটি অন্তর্ভূক্ত করা হয়। আমরা আশাবাদী। তাই জাতীয় দল গঠনের চেষ্টা করছি। এসএ গেমসে বেসবল-সফটবল অন্তর্ভূক্ত হলে এবং আমরা খেললে পদক পাওয়ার আশা করবো। কারণ, এখন আমরা ভারতকে হারাতে পারবো বলেই বিশ্বাস।’

জাতীয় দলের অনুশীলনের জন্য তিনজন বিদেশি কোচ কাজ করছেন। তবে সবাই খন্ডকালীন। অ্যাসোসিয়েশনকে কোচের বেতন দিতে হয় না। কিন্তু প্রশিক্ষণ চলাকালে তাদের নুন্যতম আতিথেয়তা দেয়া নৈতিক দায়িত্ব। ঢাকায় সমাজসেবা কাজের সঙ্গে জড়িত একজন জাপানি হিরোকি ওয়াতানেবে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই বাংলাদেশ জাতীয় দলকে ট্রেনিং দেন। তার সঙ্গে আরেক জাপানি আছেন। একজন আমোরিকানও আছেন সময় পেলে বাংলাদেশ দলকে ট্রেনিং দেন।

Baseball

অনেক খেলার মতো বেসবল-সফটবলেরও নিজস্ব কোন ভেন্যু নেই। মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়ামের দোতলায় কার্যালয়ের জন্য একটি কক্ষ বরাদ্দ দিয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। আর খেলার জন্য ব্যবহার করে থাকে পল্টন ময়দান। জাতীয় দলের অনুশীলন হয়ে থাকে রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও মিরপুর পিওএম পুলিশ লাইন্স মাঠে।

পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েদের জাতীয় দল গঠনেরও চেষ্টা চলছে। এ জন্য বাংলাদেশ বেসবল-সফটবল অ্যাসোসিয়েশন পুরুষ ও নারীদের নিয়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ করার পাশাপাশি নারীদের সফটবল চ্যাম্পিয়নশিপেরও আয়োজন করে থাকে।

নিয়মিত না পারলেও তারা নারীদের নিয়ে আন্তঃকলেজ সফটবল চ্যাম্পিয়নশিপও আয়োজন করে। পুরুষ দলের মতো নারী দল নিয়েও দারুণ আশাবাদী বাংলাদেশ বেসবল-সফটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. আমিনুল ইসলাম লিটন।

আরআই/আইএইচএস/

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।