মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ে বাস করছে ৩ শতাধিক মানুষ
বর্ষা মৌসুম এলেই ভারী বর্ষণে পাহাড়ের লালচে মাটি নরম হয়ে পড়ে। দেখা দেয় ফাটল। টুপ করেই ধসে পড়ে মাটির বড় টুকরা। মাটিচাপা পড়ার মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে ৮০টি পরিবারের প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ।
বুধবার সিলেট শহরতলির খাদিমপাড়া ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ গুচ্ছগ্রামে গিয়ে দেখা গেল এমন দৃশ্য। দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছর ধরে এখানে পাহাড়ের ওপর ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়েছেন তারা। কেউ কেউ এই সরকারি পাহাড়ে বসবাসের জমি বিক্রি করে দিয়েছেন।
সরেজমিনে পাহাড় ঘুরে দেখা গেল, গুচ্ছগ্রামের টিলা কেটে বানানো রাস্তার এক পাশে ছোট-বড় দুটি পাহাড়। বৃষ্টির পানি পাহাড়ের লাল মাটির সবুজ গাছ বেয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে টপ টপ করে পড়ছে। মাটি ভেঙে পড়ার ক্ষত ছড়িয়ে রয়েছে খাড়া পাহাড়ে।
নিচ থেকে অনেক উঁচুতে দেখা যাচ্ছে টিনশেডের একটি ঘর। ঘরের পাশেই পাহাড়ের টুকরো ভেঙে পড়ে অবশিষ্টাংশ ধসের অপেক্ষায় রয়েছে। এ অবস্থায়ও ওই ঘরের উঠোনে দুটি শিশু খেলা করছে। তারা ভাবলেশহীন।
পাশেই শিশুদের মা আফিয়া বেগম গৃহস্থলির কাজ করছেন। আশপাশে পাহাড়ে ছড়িয়ে আছে আরও ঘরবাড়ি। কাটা টিলার ফাঁকে রয়েছে আরও কয়েকটি ঘর। এসব ঘরে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। পাহাড় কেটে পথ বানানো হয়েছে। বৃষ্টির পানিতে লাল মাটি ধসে সেই পথও আর নেই। ধসে পড়া টিলার শরীর বেয়ে ঘরবাড়িতে লোকজন যাওয়া-আসা করেন।
আফিয়া বেগম জাগো নিউজকে জানান, তারা ১৫ বছর ধরে এই পাহাড়ে বসবাস করছেন। ঘরবাড়ি নেই। যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। স্বামী দিনমজুর। তিনি পরিবার নিয়ে এখানেই আশ্রয় বেঁধেছেন। গতরাত থেকে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। এতে পাহাড় ধসে পড়ছে।
পাহাড়ি টিলার ফাঁকে আলিম উদ্দিনের পরিবার একটি খুপরি টিনের ঘরে বাস করেন। তার মেয়ে বলেন, ‘ইকানো আমরা অনেক দিন ধরি থাকি। পয়লা ডর (ভয়) করতো। এখন একটু কম ডর করে। রাতে ডর নিয়ে ঘুমাই।’
ঘুরে দেখা গেল, অন্তত ৫০টি পরিবার পাহাড়ের ওপরে থাকেন। পাদদেশে বসবাস করে আরও প্রায় ৩০টি পরিবার। ঘর বানানোর আগে কেউ কেউ পাহাড় কেটে রাস্তা বানাচ্ছেন।
টিলার পাদদেশের নিচের একটি ঘরের বাসিন্দ আম্বিয়া বেগম জানান, কিছুদিন আগে টিলা ভেঙে তার ঘরের ওপরে পড়েছে। তবে ওই ঘরে কেউ থাকতো না। শুধু ঘরের ক্ষতি হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ১৯৯২ সাল থেকে এখানে ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ে লোকজন বসবাস করে আসছেন। ওই সময়ে সিলেটের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা গুচ্ছগ্রামের এই টিলার ২০০১ নম্বর দাগের ১২ একর এবং ২০১৫-১৬ নম্বর দাগের ২ একর জমি একশ বছরের জন্য বন্দোবস্ত নেন।
শুরুর দিকে কয়েকজন ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধার পরিবার ওই পাহাড়ে ঘর বানিয়ে বসবাস করে। পরে তারা পাহাড়কে ভিটায় ভাগ করে বিক্রি করে চলে যান। বর্তমানে পাহাড়ের সব পরিবারই শ্রমজীবী পরিবার। তারা পাঁচ হাজার টাকায় ওই পাহাড়েই বসবাসের জন্য স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে অনিবন্ধিত দলিলে জমি ক্রয় করে খুপরি ঘর তৈরি করে বাস করছেন।
খাদিমপাড়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনু মিয়া বলেন, মানুষের থাকার মতো জায়গা নেই। তাই তারা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে। সরকার এসব গৃহহীন পরিবারের জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবে বলে আমরা আশাবাদী।
খাদিমপাড়া ইউনিয়নের নব-নির্বাচিত চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আফছর আহমদ বলেন, আমি নতুন নির্বাচিত হয়েছি। এখনো দায়িত্ব বুঝে নেইনি। এসব পরিবারের মানবিক বিষয় ও পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়টি নিয়ে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করবো।
সিলেট সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এটা আমি জানতাম না। এখন যেহেতু জানলাম, খোঁজ নিয়ে অবশ্যই পরিবারগুলোর প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেব।
পরিবেশ অধিফতর সিলেটের উপ-পরিচালক সালাউদ্দিন বলেন, টিলা-পাহাড় কাটা বন্ধে সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে আমরা প্রতিনিয়তই নোটিশ দিচ্ছি। কোথাও পাহাড় কাটা বন্ধও করেছি। পাহাড়ে বসবাস ভিন্ন একটি বিষয়। এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেব।
ছামির মাহমুদ/এসএস/এবিএস