শীতল পাটিতে ভাগ্যবদল
দেশজুড়ে রয়েছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে তৈরি শীতল পাটির কদর। এখানকার নারীদের তৈরি পাটি অবদান রাখছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে। ভাগ্য বদলেছে ওই এলাকার কয়েকশ নারী। সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ পাটি শিল্প আরও সমৃদ্ধ হতো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মিরসরাই-সীতাকুণ্ড উপজেলার প্রাচীন বাজার বড়দারোগাহাটে বসেছে শীতল পাটির বাজার। উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে বিক্রি করতে পাটি নিয়ে এখানে ছুটে এসেছেন অর্ধশত মানুষ। তাদের মধ্যে পুরুষের পাশাপাশি ১২-১৫ জন নারীও রয়েছেন। সকাল ৯টা বাজতেই শোরগোল শেষ। সপ্তাহের প্রতি সোম-বৃহস্পতিবার এখান থেকে পাটি ক্রয় করতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনীসহ বিভিন্ন এলাকায় পাইকাররা ছুটে আসেন। এভাবে উপজেলায় আরও অন্তত সাতটি বাজারে বসে পাটির বাজার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানকার নিম্ন আয়ের পরিবারের নারীদের অন্যতম পেশা শীতল পাটি বোনা। এর কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হয় পাটিপাতা। সবুজ রঙের এ উদ্ভিদের বড় বাজার বসে উপজেলার বামনসুন্দর দারোগারহাটে। সেখান থেকে পাটিপাতা সংগ্রহ করে পানিতে ভিজিয়ে, আবরণ ছাড়িয়ে তোলা হয় দুই রকমের বেত। তারপর রঙ দিয়ে রাঙানো হয়। এরপর শুরু হয় পাটি বোনা। শিল্পীর নিপুণ হাতে শীতল পাটিতে ফুটে ওঠে গাছ-গাছালি, পাখি, মসজিদ, হরিণ, বাঘ, ফুল, হাতি, ঘোড়া আবার কখনো বা বাংলাদেশের মানচিত্র। পাটি বুনে স্বাবলম্বী ওই এলাকার কয়েকশ নারী।

উপজেলার মিঠাছড়া, বড়দারোগাহাট, শান্তিরহাট, আবুরহাট, বারইয়ারহাট, জোরারগঞ্জ ও আবুতোরাব বাজারে শীতল পাটির ব্যতিক্রমী বাজার রয়েছে। এসব বাজারে সপ্তাহে দুই দিন বাজার বসে। লেনদেন হয় প্রায় অর্ধকোটি টাকা।
জানা গেছে, উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভার প্রায় প্রতিটি গ্রামের শীতল পাটি তৈরি হয়ে থাকে। গ্রামের নারীরা দৈনন্দিন কাজে ফাঁকে ফাঁকে শীতল পাটি বুনে থাকেন। আর গ্রামীণ নারীদের বুনা এসব পাটি বিক্রয়ের নির্ভরযোগ্য বাজারগুলোতে শীতল পাটির হাট বসে খুব ভোরে। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের নারী পুরুষ তাদের বুনা শীতল পাটি নিয়ে বিক্রয়ের জন্য হাজির হয় এসব বাজারে। পাইকারি পাটি ক্রেতারা হাটের আগের দিন এসে বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে অবস্থান নেয়। গ্রীষ্মকালে এসব পাটির কদর বেশি থাকে। তবে নকশা করা শীতল পাটির কদর শহরে খুব বেশি।
উপজেলার ওয়াহেদপুর ইউনিয়নের মধ্যম ওয়াহেদপুর গ্রামের পাটি বিক্রেতা রোকেয়া আক্তার বলেন, সপ্তাহে দুইটি পাটি বুনা যায়। আগে পাটির তৈরির উপকরণ বেত সব সময় পাওয়া যেত। কিন্তু এখন বেত হারিয়ে যাচ্ছে। তাই পাটি তৈরিতে এখন খরচ বেশি হয়। প্রতিটি পাটি আকার ভেদে ১২শ টাকা থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। তবে পাইকারি বিক্রি করায় গ্রামীণ নারীরা বেশি দাম পান না। একাধিক হাত ঘুরে এসব পাটি দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় পৌঁছে।

মিরসরাইয়ে সবচেয়ে বেশি শীতল পাটি তৈরি হয় উপজেলার ইছাখালী, বামনসুন্দর, কাটাছরা, নাহেরপুর, ইসলামপুর, ওয়াহেদপুর ও মিঠাছড়া এলাকায়।
উপজেলার কাটাছরা ইউনিয়নের বঙ্গনুর এলাকার আবু তাহের বলেন, আমাদের গ্রামে প্রায় প্রতিটি বাড়ির পাশে পাটিপাতার বাগান রয়েছে। আগে আরও অনেক বেশি ছিল। ঘরবাড়ি করার কারণে এখন অনেক কমে গেছে। এক সময় আমাদের মা-চাচিরা পাটি তৈরি করলেও এখন তৈরি হয় না। আমরা পাটিপাতা বাইরে বিক্রি করে দিই।
ফেনী থেকে মিঠাছরা বাজারে আসা পাটি ব্যবসায়ী নুরুল অলম বলেন, মিরসরাইয়ের শীতল পাটির চাহিদা অন্য এলাকা থেকে একটু বেশি। কারণ এখানকার পাটির আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিশেষ করে নির্মাণশৈলী অনেক টেকসই।

মিঠাছরা বাজারে গিয়ে কথা হয় পাটি শিল্পী নুরের নেছার সঙ্গে। তার বাড়ি উপজেলার জনাদ্দনপুর গ্রামে। তিনি ২৫০০ টাকা করে দুটি শীতল পাটি বিক্রি করেছেন। তিনি জানান, ‘দুধারি’ একটি শীতল পাটি বুনতে একজন নারীর কমপক্ষে পাঁচদিন সময় লাগে। কাঁচামালসহ অন্যান্য খরচ পড়ে ৮০০ টাকা।
চট্টগ্রাম শহরের রিয়াজ উদ্দিন বাজার থেকে পাইকারীভাবে পাটি কিনতে আসা আড়তদার নুরন্নবী বলেন, এখানকার পাটির বেশ কদর রয়েছে। এখান থেকে পাটি কিনতে হলে খুব ভোরে আসতে হয়। আমি এখান থেকে নিয়ে শহরে আড়তে রাখি। সেখান থেকে বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যান।
মিঠাছরা বাজার উন্নয়ন কমিটির সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, মিঠাছরা একটি প্রাচীন বাজার। এ বাজারে অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি শীতল পাটিও বিক্রি হয়। মিরসরাই-সীতাকুণ্ড উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ এ বাজারে পাটি বিক্রি করতে আসেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে শীতল পাটির বাজারও বসছে এখানে।
আরএইচ/জেআইএম