খুঁড়িয়ে চলছে ঈশ্বরদীর রেশম বীজাগার
এক সময় ঈশ্বরদীর রেশম বীজাগারে পলু পালন, রেশম ডিম, রেশম গুটি উৎপাদন হতো। গুটি থেকে হতো সুতা। পাশাপাশি বছরজুড়েই চলতো তুত গাছ চাষাবাদের কর্মযজ্ঞ। বর্তমানে এখানে স্বল্প পরিসরে শুধু তুত গাছের চারা উৎপাদন চলছে। এছাড়া বন্ধ বাকি সব কার্যক্রম। ফলে কর্মচাঞ্চল্য বছরজুড়েই এ রেশম বীজাগার থাকে নীরব-নিস্তব্ধ। কার্যক্রম চলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
রেশম বীজাগার অফিস পরিচালনায় ১৭ পদে লোকবল থাকার নিয়ম থাকলেও শুধু ম্যানেজার (ভারপ্রাপ্ত) রয়েছেন। বাকি সব পদই খালি। এছাড়া মাসিক চুক্তিভিত্তিক একজন কম্পিউটার অপারেটর, দৈনিক হাজিরাভিত্তিক ২২ শ্রমিক ও চার নৈশপ্রহরী কর্মরত। মাসে ১০-১৫ দিনের বেশি কাজ হয় না। ফলে দৈনিক হাজিরাভিত্তিতে নিয়োগ করা শ্রমিকদের মানবেতন জীবনযাপন করতে হচ্ছে।
রেশম বীজাগার অফিস সূত্রে জানা যায়, ঈশ্বরদী-পাবনা মহাসড়কের অরণকোলা মৌজায় ১৯৬২ সালে ১০৭ বিঘা ১২ কাঠা জমিতে রেশম বীজাগার স্থাপিত হয়। এখানে তুত গাছ আবাদি জমি ৫৯ বিঘা। বাকি ৩৮ বিঘা জমিতে অফিস, আবাসিক ভবন, পলু পালন ঘর, তাঁত ঘরসহ ১৯ ভবন ও চারটি পুকুর রয়েছে। এক সময় তুত গাছের পাতা পলু পোকা দিয়ে খাইয়ে রেশম ডিম ও গুটি উৎপাদন হতো। সে রেশম গুটি থেকে তৈরি হতো সুতা। এখন আর এসব কোনো কার্যক্রম নেই। শুধু তুতের চারা উৎপাদন হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, রেশম বীজাগারের প্রায় ৫০ হাজার তুত গাছ মরে যাচ্ছে। পলুপোকা পালন, রেশম গুটি ও রেশম ডিম উৎপাদন বন্ধ থাকায় তুত গাছের পরিচর্যা হয় না। ফলে তুত গাছের জমি জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। পলু পোকা পালন, রেশম গুটি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত একতলা চারটি ও দোতলাবিশিষ্ট দুটি বিশাল ভবন রয়েছে। এর মধ্যে একতলা চারটি ভবন পরিত্যক্ত। ভবনের ছাদের পলেস্তারা খুলে এবং জানাল-দরজা ভেঙে যাওয়া সেখানে লতাপাতা গজিয়ে উঠে ঝোপঝাড়ে তৈরি হয়েছে। ফলে বিরাজ করছে ভূতুড়ে পরিবেশ।
রেশম বীজাগারের শ্রমিকরা জানান, এখানকার সোনালি অতীত রয়েছে। তুতের চারা উৎপাদন, পলু পোকা পালন, রেশম ডিম ও গুটি উৎপাদনের পাশাপাশি একসময় এখানে রেশমের গুটি থেকে সুতা তৈরি হতো। সে সুতা রাজশাহী সিল্ক কারখানায় যেত। তৈরি হতো বিশ্ব বিখ্যাত সিল্কের শাড়িসহ নানান পোশাক। এখন শুধু ৩৫ বিঘা জমিতে তুতের চারা উৎপাদন কার্যক্রম চলমান। বাকি সব বন্ধ।
আরও পড়ুন: রেশম চাষে স্বাবলম্বী কয়েকশ নারী
শ্রমিকরা আরও জানান, ২০১৯ সালের ২৭ জুন এ বীজাগারের পাঁচজন শ্রমিককে অবসরজনিত বিদায়ের কারণে রেশম বোর্ড কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে শ্রমিকরা। দীর্ঘদিন আন্দোলনের ফলে কর্তৃপক্ষ বীজাগারের সব কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। প্রায় আড়াই বছর পর ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর রেশম উন্নয়ন প্রকল্পের একটি প্রজেক্টের আওতায় তুতের চারা উৎপাদনের অনুমোদন দেওয়া হয়। চারা উৎপাদন কাজ মাসে ১২-১৫ দিন হয়। বাকি দিন বন্ধ থাকে। ফলে শ্রমিকদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়।
রেশম বীজাগারের শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সুবল চন্দ্র সরকার জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘ আড়াই বছর এ বীজাগারের সব কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর পুনরায় চালু হলেও কর্মরত শ্রমিকদের পুরো মাস কাজের সুযোগ নেই। মাসের অধিকাংশ দিন কাজ থাকে না। অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এখানে কর্তৃপক্ষ পলু পালন, রেশম ডিম, রেশম গুটি উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। রেশম উন্নয়ন বোর্ডের বর্তমান ঊধ্বর্তন কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি বীজাগারে পলু পালন, ডিম ও রেশ গুটি উৎপাদন পুনরায় চালু করুন। তাহলে শ্রমিকদের মাসব্যাপী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ বীজাগারে ৩০ বছর কাজ শেষে শ্রমিকরা অবসরে যাওয়ার সময় কর্তৃপক্ষ খালি হাতে শ্রমিকদের বিদায় দেয়। ফলে বৃদ্ধ বয়সে শ্রমিকদের অর্থকষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়।
আরও পড়ুন: ‘বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের রেশম শিল্পকে মডেল হিসেবে তৈরি করতে চাই
রেশম বীজাগার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আলাউদ্দিন ফকির সরকার জাগো নিউজকে বলেন, দৈনিক হাজিরাভিত্তিতে এ বীজাগারে ২২ শ্রমিক কর্মরত। বর্তমানে এ বীজাগারে শুধু তুত চারা উৎপাদন কাজ চলছে। মাসের অধিকাংশ দিন কাজ না থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটাতে হয়।
ঈশ্বরদী রেশম বীজাগারের ভারপ্রাপ্ত ফার্ম ম্যানেজার মো. হায়দার আলী বলেন, প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে পলু পালন, রেশম ডিম ও রেশম গুটি উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ। শুধু রেশম শিল্প ও সম্প্রসারণ শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৫ বিঘা জমিতে তুত চারা উৎপাদন শুরু হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ৩৫ বিঘায় করা হয়েছে। এসব চারা রেশম উন্নয়ন বোর্ডের নির্দেশনায় বিনামূল্যে বিভিন্ন এলাকায় চাষিদের মাঝে বিতরণ করা হয়। পলু পোকা পালন, রেশম ডিম ও গুটি উৎপাদনে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এসব কার্যক্রম বন্ধ। অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেলে পুনরায় সব কার্যক্রম পরিচালিত হবে।
আরও পড়ুন: সুদিনে ফেরার অপেক্ষায় বাংলাদেশ রেশম বোর্ড
বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মাহাবুবুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, রেশম উন্নয়ন বোর্ডের জনবল সংকটের কারণে ঈশ্বরদী রেশম বীজাগারে অনিয়মিত শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো হয়। অনিয়মিত শ্রমিকরা বিভিন্ন সময় অবৈধ ও অনৈতিক দাবি রেশম বোর্ডে উপস্থাপন করে। এ নিয়ে রেশম বোর্ড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের দূরত্বের সৃষ্টি হয়। ফলে একপর্যায়ে এ বীজাগারের পলু পালন, রেশম ডিম ও গুটি উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় পলু পালন, রেশম ডিম ও গুটি উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। সরকারি অর্থপ্রাপ্তি সাপেক্ষে পুনরায় এসব কার্যক্রম চালু হতে পারে।
এএইচ/এমএস