নিঃসঙ্গ জীবনে মৃত্যুর অপেক্ষায় বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দারা
অডিও শুনুন
‘আমার একটাই ছেলে। অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছি। খেয়ে না খেয়ে মানুষের বাড়িতে কাজ করে খাইয়েছি। বিয়ের পর আর আমার খোঁজ নেয় না। শেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে এখানে (বৃদ্ধাশ্রম) থাকি। ঈদ গেলো তাও কেউ দেখা করতে আসেনি।’
কথাগুলো বলছিলেন আম্বিয়া বেগম। স্বামীর মৃত্যুর পর পাল্টে গেছে তার চিরচেনা সম্পর্কগুলো। সন্তানের কাছে জায়গা না পেয়ে আম্বিয়া বেগমের ঠিকানা এখন নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার ‘নিরাপদ’ বৃদ্ধাশ্রমে।
এই বৃদ্ধাশ্রমে ১১ জন মায়ের জীবনের গল্প কমবেশি একই রকম। একটা সময় যারা আঁচলে চাবি বেঁধে সংসার সাজিয়েছেন, সন্তানকে গড়ে তুলতে যারা বিলিয়েছেন জীবনের সবকিছু। তারাই আজ সমাজ বিতাড়িত। নিয়তির কোনো এক খেলায় তারা আজ বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা।
নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে থাকা ১১ জন মায়ের মধ্যে ৬ জনই হারিয়েছেন মানসিক ভারসাম্য। পরিবারের শোকে অনেকেই হয়েছেন নির্বাক। তবে তাদের প্রত্যাশা একটাই, কোনো একদিন সন্তানরা ভুল বুঝে তাদের ফিরিয়ে নেবে চিরচেনা সেই সংসারে। যেখানে আছে সন্তান, আত্মীয়-স্বজন সবাই। কেউ কেউ আবার মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন।
পঞ্চগড়ের জহুরা বেগম। এক দুর্ঘটনায় ছেলেকে হারিয়েছেন। স্বামীর মৃত্যুর পর আর ঠাঁই হয়নি আত্মীয়-স্বজন কিংবা ভাইদের কাছে। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে এখন তার ঠাঁই হয়েছে নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে।
জহুরা বেগম বলেন, আমার ছেলে মারা গেছে, স্বামীও মারা গেছে। এখন খুব কষ্টে আছি। কেউ খোঁজ নেয় না।
নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমের আরেক বাসিন্দা লাইলী বেগম। গাজীপুরের ৫তলা বাড়ি ও জমি লিখে দিয়েছেন ছেলেকে। কিন্তু সেই ছেলের কাছেই জায়গা মেলেনি তার। রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে হারিয়েছেন মানসিক ভারসাম্য। মাস পাঁচেক আগে লাইলী বেগমের ঠাঁই হয়েছে এই নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে।
নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমে প্রবীণ মায়েদের পাশাপাশি ঠাঁই মিলেছে বৃদ্ধ বাবাদেরও। তাদের জীবনের গল্পটাও একই রকম। কেউ সন্তানদের মানুষ করতে নিজেকে উজাড় করেছেন। কেউ কেউ হয়েছেন প্রতারণার স্বীকার। আবার কেউ সন্তানের নির্যাতনের ভয়ে ঠাঁই নিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে৷ তাদের মধ্যে অনেকেই সবকিছু হারিয়ে এখন প্রহর গুণছেন শুধু মৃত্যুর।
ষাটোর্ধ্ব মফিজার রহমান বলেন, ২টা ছেলে। তাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছি। তারা কেউ আমার খোঁজ নেয় না। ঈদ যে গেল কেউ দেখাও করতে আসলো না। এমন অবস্থায় আছি এখানে। কী আর করার, এখন অপেক্ষা শুধু ওপারে যাওয়ার।
মকবুল হোসেন নামে আরেক বাবা বলেন, আমার কেউ কোনো খোঁজ নেয় না বাবা। আমার বেটি আছে, খোঁজ নেয় না। বউ আছে, সেও খোঁজ নেয় না। এখানে সাজু বাবা আনি আমাকে খাওয়ায়। মাছ খাওয়ায়, গোস্ত দিয়ে ভাত খাওয়ায়। আমার আর কোনো চাওয়া নাই। আল্লাহর কাছে শুধু সবার জন্য দোয়া করবো।
নিরাপদ বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সাজ্জাদুর রহমান সাজু বলেন, এখানে ১১ জন মা আছেন। তাদের দেখাশুনা করি আমি একা। তার মধ্যে অনেকেই মানসিক ভারসাম্যহীন। চেষ্টা করি তারা যেন ভালো থাকেন। আমি প্রত্যাশা করি, প্রতিটি ছেলে যেন তাদের মা-বাবাকে নিয়ে যান। প্রতিটা বাবা-মা যেন শেষ বয়সে সন্তানের কাছে নিরাপদ একটা আশ্রয় পান।
এফএ/জিকেএস