অধ্যাপক নিলুফার আখতার
দুর্যোগ পরিস্থিতিতে প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক রোগে আক্রান্ত হন
দুর্যোগ বা জরুরি পরিস্থিতি মানবদেহের শুধু শারীরিক ক্ষতিই করে না, পাশাপাশি মানসিক অবস্থায় ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। এমন পরিস্থিতির শিকার প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন মানসিক রোগে আক্রান্ত হন।
‘বিপর্যয়-জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এ তথ্য জানিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ডা. নিলুফার আখতার জাহান।
বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) জাগো নিউজ কার্যালয়ে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সম্পাদক কে. এম. জিয়াউল হকের সভাপতিত্বে ও প্ল্যানিং এডিটর মনিরুজ্জামান উজ্জ্বলের সঞ্চালনায় আলোচনায় আরও অংশ নেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মুনতাসীর মারুফ, সহকারী অধ্যাপক ও শিশু-কিশোর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সাদিয়া আফরিন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. এস এম জিকরুল ইসলাম, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট মেজবাউল ইসলাম, সাইক্রিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার জামাল হোসেন, সিনিয়র স্টাফ নার্স শফিউল আজম, মনের বন্ধুর সিনিয়র কাউন্সেলর মেহেদী মোবারক আমান এবং জাগো নিউজের ডেপুটি এডিটর ড. হারুন রশীদ।

অধ্যাপক নিলুফার বলেন, দুর্যোগ বা জরুরি পরিস্থিতির মধ্যে প্রায় প্রত্যেক মানুষের মানসিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যেমন দুশ্চিন্তা, হতাশা, রাগ, ঘুমের সমস্যা, কাজের প্রতি আগ্রহের অভাব ও শারীরিক উপসর্গ। তবে বেশির ভাগ মানুষের জন্য এ প্রতিক্রিয়াগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন মানসিক রোগে আক্রান্ত হন, বিশেষ করে যাদের মধ্যে আগেই মানসিক সমস্যা ছিল।
রোগের ধরন ও লক্ষণ
এ বিশেষজ্ঞ জানান, গবেষণায় দেখা গেছে যে দুর্যোগের পর প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হন। এর মধ্যে ১৩ শতাংশ মানুষ মৃদু মানসিক রোগে যেমন অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার, ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার, অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিসঅর্ডার ও পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে (পিটিএসডি) আক্রান্ত হন। বাকি ৯ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হন গুরুতর মানসিক রোগ যেমন সিজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারে।
আরও পড়ুন
যেকোনো বিপর্যয়ে মনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা জরুরি
বছরে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫০-৬০ লাখ মানুষ
গাছ কমাতে পারে আপনার মানসিক চাপ
ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে রোগীরা দীর্ঘ সময় বিষণ্নতায় ভোগেন, কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন ও কখনও কখনও আত্মহত্যার চিন্তাও করেন। অন্যদিকে, অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্তদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, রাগ, ঘুমের সমস্যা, শারীরিক উপসর্গ যেমন বুক ধরফর করা এবং নিঃশ্বাসের কষ্ট দেখা দেয়।
অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিসঅর্ডার ও পিটিএসডি সম্পর্কে অধ্যাপক নিলুফার জানান, যে কোনো বড় দুর্ঘটনা বা বিপর্যয়ের পর মানুষের মধ্যে অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিসঅর্ডার হতে পারে। যদি তা এক মাসের মধ্যে নিরাময় না হয় তবে তা পিটিএসডিতে পরিণত হতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে প্রায়ই স্মৃতিচিহ্ন পুনরাবৃত্তি হওয়া, স্বপ্নে পুনরাবৃত্তি হওয়া ও সে ঘটনা এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা যায়।
যারা পেশাগত কারণে বারবার এ ধরনের মৃত্যু-সংশ্লিষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনা মোকাবিলা করেন, যেমন সাংবাদিক বা পুলিশ কর্মকর্তা, তাদের মধ্যেও পিটিএসডি হতে পারে বলে উল্লেখ করেন এ বিশেষজ্ঞ।

প্রতিকার ও সেবা
অধ্যাপক নিলুফার বলেন, দুর্যোগের পর সঠিক মানসিকসেবা দিতে দেশের মানসিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে। মানসিক রোগীদের তাৎক্ষণিক সেবা নিশ্চিত করার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি খাতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। তিনি এ ধরনের সেবার জন্য প্রশিক্ষিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে বিশেষ দল গঠন এবং নির্দিষ্ট সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেন।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক নিলুফার আরও বলেন, মনের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন কোনো পরিস্থিতির শিকার হওয়া একজন মানুষকেও মানসিকসেবা দেওয়া জরুরি। তাই দেশে এ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবার শাখা এবং এর কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি করা উচিত, যেন কোনো দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে কেউ মানসিক চাপের শিকার না হন।
এসইউজে/একিউএফ/এএসএম