কোন দেশে ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স কত?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৪৯ পিএম, ২৩ মার্চ ২০২৫
ছবি: এএফপি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স আইন দ্বারা স্বীকৃত। ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ এবং ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাসের তথ্য মতে, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। এই দুটি সংস্থার ওয়েব সাইট থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় সেখানে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ২৩৬টি দেশের মধ্যে মাত্র ১০টি দেশে ১৬ বছর এবং ৬টি দেশে ১৭ বছর বয়সকে ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স হিসেবে গণ্য করা হয়।

ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইকুয়েডর, কিউবা, অস্ট্রিয়া, নিকারাগুয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনিয়া এবং মাল্টাতে ভোটার হওয়ার বয়স ১৬ বছর। এর মধ্যে আর্জেন্টিনায় ১৬ বছর বয়স থেকে ভোট দেওয়া গেলেও তা ঐচ্ছিক, সেখানে ১৮ বছর বয়স থেকে ভোটদান বাধ্যতামূলক।

বসনিয়াতে চাকরিজীবী হলেই কেবল ১৬ বছর বয়সীরা ভোট দিতে পারেন। হাঙ্গেরিতে সাধারণত ১৮ বছর বয়সীরা ভোট দেওয়ার অধিকার পেলেও ১৬ বছর বয়সের বিবাহিতরা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। আবার এস্তোনিয়ায় ১৬ বছর বয়সীরা স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে ১৮ বছর বয়সের আগে তারা ভোট দিতে পারেন না।

ইন্দোনেশিয়া, উত্তর কোরিয়া, পূর্ব তিমুর, সুদান ও গ্রিসে ১৭ বছরে পা রাখলেই একজন ব্যক্তি ভোট দেওয়ার যোগ্য হন। ইসরায়েলে ১৭ বছর বয়সীরা স্থানীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারলেও জাতীয় নির্বাচনের জন্য এই বয়সসীমা ১৮ বছর।

ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাদেশের প্রতিবেশী সব দেশেই ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। এশিয়ায় চীন, জাপান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ায, মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, ইরাক, ইরান, সিরিয়া ও লিবিয়া, ইউরোপের যুক্তরাজ্য, নরওয়ে, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ইতালি, স্পেন ও নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা ও অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা মহাদেশের মিসর, উগান্ডা, তিউনিসিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ভোট দেওয়ার সর্বনিম্ন বয়সসীমা ১৮ বছর।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে এর ব্যতিক্রম রয়েছে। সেগুলোতে ১৭ বছরেও ভোট দেওয়া যায়। জার্মানির কয়েকটি প্রদেশের পাশাপাশি পৌরসভা নির্বাচনেও ১৬ বছর বয়সীরা ভোট দিতে পারে। বাকি প্রদেশ ও জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। এশিয়ায় একমাত্র দক্ষিণ কোরিয়ায় ভোট দেওয়ার বয়স হলো ১৯ বছর। ক্যামেরুন, তাইওয়ান, বাহরাইন ও নাইরুতে ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ২০ বছর। কুয়েত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, লেবানন ও ওমানে ভোটার হওয়ার সর্বনিম্ন বয়সসীমা হলো ২১ বছর। আরব আমিরাতে ভোটার হতে হলে এই বয়সসীমা আরও লম্বা, সেখানে ২৫ বছরের আগে ভোটার করা হয় না।

একটি মৌলিক প্রশ্ন এখানে এসে যায়, সেটা হলো- বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স কেন ১৮ বা তার বেশি? ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারণ নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে বিতর্ক তা গবেষক মহলেও ছড়িয়েছে। বিশ্বের খুব অল্পসংখ্যক দেশে আমরা দেখতে পাই ১৮ বছরের কম বয়সীরা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন। আবার ভোটের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে আনার পক্ষে অনেকে যুক্তি দেন। তাদের যুক্তি হলো, এর মাধ্যমে একটি দেশ তার ভবিষ্যৎ গঠনে তরুণদের কণ্ঠস্বরের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিতে পারে।

এর প্রধান সুবিধা হলো- আরো বেশি সংখ্যক তরুণ নাগরিকের সম্পৃক্ততা বাড়ানো যায়। তরুণদের জীবন ও ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করে এমন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তরুণদের অংশীদারিত্ব বাড়ানোর সুযোগ বাড়বে। যেমনটা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাও যুক্তি দিয়েছেন, তরুণরা সংখ্যায়ও বেশি। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তারা আগ্রহী। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মতামত নেওয়ার জন্য আমি মনে করি, ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর নির্ধারিত হওয়া উচিত।

এটি বিশ্বব্যাপী যারা ভোটারের বয়স কমাতে চান, তাদের প্রধান যুক্তি। তারা মনে করেন, তরুণদের যত বেশি সক্রিয় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ হয়, ততই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। যদি তরুণ নাগরিক, যারা নীতির দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক, পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক পরিণতি বহন করে, তাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্বের অভাব থাকে, তবে একটি ‘গণতান্ত্রিক ঘাটতি' দেখা দেয়।

জলবায়ু পরিবর্তন, ডিজিটাল প্রশাসন এবং ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশনের মতো সমসাময়িক চ্যালেঞ্জগুলো প্রায়ই কিশোর-কিশোরীদের কাছে আকর্ষণীয় বিষয়। এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তরুণদের আগে ভোটাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে সম্মিলিত নির্বাচনী সিদ্ধান্তগুলোতে অন্তর্নিহিত দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশস্ত করা যায়।

যারা ভোটারের বয়স কমানোর পক্ষে, তাদের যুক্তি হলো, রাজনৈতিক অংশগ্রহণের এই স্ব-শক্তিশালীকরণ প্রকৃতি কেবল ব্যক্তিকেই উপকৃত করে না, বরং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধতাকেও শক্তিশালী করতে পারে। এতে রাজনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্বেগের বিষয়ে আরো মনযোগ বাড়াবে।

যুক্তরাষ্ট্রে ভোট দেওয়ার বয়স ১৮ বছর। দেশটির সংবিধানের ২৬তম সংশোধনীর মাধ্যমে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স ছিল ২১ বছর। ১৮ বছর করার পেছনের ইতিহাস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ের। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক খসড়ায় বয়স কমিয়ে ১৮-তে নামিয়ে এনেছিলেন। তখন যেহেতু তরুণদের যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়েছিল, অনেকে যুক্তি দিয়েছিলেন যে তারা যদি তাদের দেশের জন্য লড়াই করার মতো যথেষ্ট বয়স্ক হন তবে তাদেরও ভোট দেওয়ার মতো যথেষ্ট বয়স হওয়া উচিত।

বেশিরভাগ গবেষক মনে করেন, ভোটারের বয়স ১৮ বছরের নিচে হওয়া উচিত নয়। যারা ১৮ বছরের কম বয়সীদের ভোটার করতে আগ্রহী নয় তাদের মধ্যে যে উদ্বেগগুলো কাজ করে, তার একটি হলো-তরুণ ভোটারদের পরিপক্কতা এবং ভোটদানের আচরণ। আপনি মনে করতে পারেন, ১৬ বছর বয়সীরা ভোট দেওয়ার জন্য যথেষ্ট দায়বদ্ধ। কিন্তু এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং জটিল বিষয়গুলো বোঝার ক্ষমতা বয়স্ক প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে আলাদা হতে পারে। বাহ্যিক কারণগুলো সহজেই তরুণ ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে, যারা রাজনৈতিক বিষয়ে পুরোপুরি অবহিত বা জ্ঞাত মতামত না-ও পেতে পারে। এর ফলে না জেনে বা না বুঝে ভোটদানের প্রবণতা বাড়তে পারে। বাংলাদেশে ১৭ বছরের তরুণ কলেজের গণ্ডি পেরোয় না।

আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় তাদের যে জানার জগত সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নোট বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। অনেকেই যুক্তি দিতে পারেন যে, গুগলের এই যুগে তরুণদের হাতে যে প্রযুক্তি আছে তার ফলে তারা সবকিছু জেনে যায়। কিন্তু এরই মধ্যে এটাও প্রমাণ হয়ে গেছে যে, যত বেশি প্রযুক্তি তত বেশি তথ্য বিশৃংখলার আশঙ্কা থেকে যায়।

ভুল ও অপতথ্যের জগতে তত বেশি বিচরণ ঘটছে আমাদের। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে শিক্ষার কোনো পর্যায়ে গণমাধ্যম সাক্ষরতার পাঠদান হয় না। ফলে প্রযুক্তি ও তথ্যের অপব্যবহারের শিকার হওয়ার সর্বোচ্চ আশঙ্কার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আমাদের তরুণরা।

এমন বাস্তবতায় যত কম বয়সীদের ভোটার করা হবে ততই কম জানা ও ভুল জানা ভোটারের সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। এটি আবেগপ্রবণ ভোটারের সংখ্যা বাড়াবে। এমনিতেই বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের দেশগুলোতে শুধু রাজনৈতিক দলের মধ্যে নয়, আমাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের চর্চা হয় পারিবারিক প্রভাবকেন্দ্রিক। এর দ্বিমুখী প্রভাব বেড়ে যেতে পারে। একটি হলো পারিবারিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রভাবিত হয়ে নতুন ভোটাররা ভোট দিতে পারে। আরেকটি হলো, ভোট দেওয়ার বয়স কমানোর ফলে রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে পরিবারের সদস্য, সহকর্মী, বন্ধু ও সম্প্রদায়ের মধ্যে আরো বিভাজন দেখা দিতে পারে।

ভোটারের সর্বনিম্ন বয়স সীমা না কমানোর পক্ষে দ্বিতীয় যুক্তি হলো- ভোট দেওয়ার বয়স কমানো হলে এর সম্ভাব্য পরিণতি রাজনীতির বাইরেও বিস্তৃত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, রাজনৈতিক প্রচারণা তরুণ ভোটারদের লক্ষ্যবস্তু করতে পারে, যা মেরুকরণের প্রভাব সৃষ্টি করে। উপরন্তু ভোটদানের বয়স কমানো হলে বর্তমান ভোটদান প্রক্রিয়ায় যৌক্তিক জটিলতা যুক্ত করতে পারে যেমন- অতিরিক্ত ভোটদানের স্থান, ভোটার নিবন্ধন।

এদিকে বাংলাদেশে নির্বাচন বিষয়ে সংস্কারের সুপারিশে নির্বাচনে ভোট দিতে ভোটারের বয়স সর্বনিম্ন ১৬ বছর এবং প্রার্থীর বয়স ২৩ বছর করার প্রস্তাব দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আগামীকাল রোববার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যালয়ে সংস্কার প্রস্তাবের ওপরে দলটির মতামত জানানো হবে। সেখানে এসব মতামত জানাবে দলটি।

শনিবার (২২ মার্চ) দলটির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং সংস্কার সমন্বয় কমিটির কো-অর্ডিনেটর সারোয়ার তুষার। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার সুপারিশমালার স্রেডশিট সাবমিশন এবং সংস্কার সমন্বয় কমিটির পরিচিতি উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলন করে এনসিপি।

সারোয়ার তুষার বলেন, সংস্কার প্রস্তাবে বলা হয়েছে প্রার্থীর ন্যূনতম বয়স ২১ বছর। আমরা মনে করছি এটা ২৩ বছর হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা মনে করছি ভোট দেওয়ার বয়স ১৬ বছর হতে পারে। এর কারণ হচ্ছে এবারের অভ্যুত্থানকে সারা বিশ্বের জেন-জির অভ্যুত্থান বলা হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানে তাদের এত বড় একটা স্টেপ তৈরি হলো, এরপর পরবর্তিত যে বাংলাদেশ এবং আসন্ন যে নির্বাচন সেই নির্বাচনে তারা মতামত দিতে পারবে না শুধুমাত্র বয়স ১৮ বছরের নিচে হওয়ার কারণে। এটা আমরা যৌক্তিক মনে করছি না। এজন্য ১৬ বছর ভোটারের বয়স করার জন্য আগামীকাল আমরা প্রস্তাব করবো।

সূত্র: ডয়েচে ভেলে

টিটিএন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।