শেষ পর্ব

জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্য ও বাংলার লোকজ চেতনা

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:৩৯ পিএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীন, ছবি: সংগৃহীত

নজরুল ইসলাম সাজু

ভাষা, ছন্দ ও আঞ্চলিক রীতি: জসীম উদ্‌দীনের কাব্যভাষার বৈশিষ্ট্য
বাংলা কবিতায় ভাষা ও ছন্দের প্রয়োগ বহু কবির হাতে বিভিন্ন রূপে বিকশিত হয়েছে। কেউ ভাষাকে অলংকারে সাজিয়েছেন, কেউ গাঢ় রূপকে ভরিয়ে তুলেছেন, কেউবা করেছেন ছন্দের জটিল ব্যাকরণচর্চা। কিন্তু জসীম উদ্‌দীন এ ধারাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে নিয়ে যান—তিনি ভাষাকে করেছেন গ্রামের উঠোনের ধুলো-মাটি, রাখালের বাঁশি, কুটিরের কথা। তাঁর কবিতা এত সহজ ও প্রাণবন্ত, যেন মনে হয়, কবি আমাদের পাশের বাড়ির একজন মানুষ—যিনি মাটির গন্ধে ভিজে, বুকভরা প্রেমে কাঁদে।

এ অধ্যায়ে আমরা বিশ্লেষণ করবো তাঁর ভাষার সহজতা, ছন্দের বৈচিত্র্য ও আঞ্চলিক রীতি—যা তাঁকে অন্য কবিদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করেছে।

১. ভাষার সহজতা ও হৃদয়গ্রাহী রূপ
জসীম উদ্‌দীনের কবিতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো—অলংকারহীন, প্রাঞ্জল, অথচ আবেগঘন ভাষা। তিনি আড়ম্বর পরিহার করে, সরল শব্দে মানুষের জটিল অনুভূতিকে ফুটিয়ে তোলেন। এ সরলতা তার কাব্যকে দিয়েছে গণমানুষের ভাষা।
উদাহরণ:
‘তুই বিদেশ যাইবি ভাই,
আমি থাকি গাঁয়ে রে,
বলিস ভাই রে ভুইলা যাইস না
মোরে এই মায়ে রে!’
এ ভাষা কোনো অভিধান থেকে নয়, এসেছে গ্রামের মুখ থেকে। তাই পাঠকের হৃদয়ে গেঁথে যায়।

২. আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার
জসীম উদ্‌দীন বাংলা সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষা ও উপভাষাকে সম্মানজনক আসনে বসান। তিনি দেখিয়েছেন, আঞ্চলিক ভাষা কেবল হাস্যরস বা লোকগীতিতে নয়—সাহিত্যিক মহিমায়ও পূর্ণ হতে পারে। তাঁর ব্যবহৃত শব্দ ও বাক্যরীতি: ভুইলা, তুই, গাঁয়ে, মায়ে রে, রূপাই, কাঁথা, ইত্যাদি। শব্দগুলো যাদের কাছে ‘অসাহিত্যিক’ মনে হয়েছিল, কবি তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন—‘এই ভাষাই তো সত্য, এই ভাষাই আমাদের আত্মা।’

৩. ছন্দ ও কাব্যগঠন
জসীম উদ্‌দীন সাধারণত অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখেছেন। তবে তাঁর ছন্দ কখনোই কঠোর বা যান্ত্রিক নয়—বরং সুরেলা, নরম এবং গীতিময়। উদাহরণ (নকশী কাঁথার মাঠ থেকে):
‘সাজু কাঁথা ফেলে রেখে মরে,
মাঠে পড়ে রহিল ধূলায় পড়ে...’
এ ছন্দ স্বাভাবিক তবুও কাব্যিক; পাঠক অনায়াসে অনুভব করতে পারেন এর সুর ও ব্যথা।

৪. লোকগীতির ছন্দ ও গঠন
তাঁর কবিতা অনেক সময় লোকগান, পালাগান বা রাখালদের গানের ছন্দে লেখা। এতে একটি সংগীতধর্মিতা থাকে—পাঠক মনে করেন, যেন কেউ গান গাইছে বা সুর ভেসে আসছে:
‘পিঞ্জিরা খুলে দে মা, আমি আর থাকতে পারি না’
‘পল্লীজননী ডাকিছে তার পরান পুতুল খেলা থামায়ে আয় রে...’
এ পঙক্তিগুলোয় আছে নদীর ঢেউয়ের মত এক ধরনের দুলুনি ছন্দ।

৫. বচনরীতি ও সংলাপ
সোজন বাদিয়ার ঘাট, নকশী কাঁথার মাঠের মতো কবিতা-নাটকে জসীম উদ্‌দীন গ্রামীণ সংলাপভাষা ব্যবহার করেছেন। তার সংলাপগুলো সরাসরি পল্লির মানুষের কণ্ঠ থেকে নেওয়া। যেমন:
‘সোজন: মারে কইয়ো না কিছু, দুলালী।
তোর কতা কইলে মোরে বেইমান কইব।
আমি তোরে শুধু চাহি, তোরে পাইবার লাইগা নয়।’
এখানে যে কথা, তা শহুরে মানদণ্ডে হয়তো পরিপাটি নয় কিন্তু বাস্তব ও হৃদয়স্পর্শী।

৬. উপমা ও রূপকের প্রয়োগ
কবি সাধারণত দৈনন্দিন জীবনের জিনিসকেই রূপক করেন। যেমন:
কাঁথা = নারীর শোকের প্রতিচ্ছবি
নদী = বিচ্ছেদের সীমারেখা
বাঁশি = প্রেমের ভাষা
মাঠ = স্মৃতির উপকরণ।
এসব উপমা এতটাই গ্রামীণ, তবু গভীর—যা বাংলা সাহিত্যে এক ভিন্নমাত্রা এনেছে।

লোকসংস্কৃতি, গান ও কাহিনিচিত্র: সাহিত্যে গ্রামীণ আত্মার নবান্ন
পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্য শুধু কাব্য নয়, তা এক সজীব লোকজ গ্রন্থাগার। তাঁর রচনার পরতে পরতে মিশে আছে বাংলার লোকসংস্কৃতি, গান, লোককাহিনি, প্রবাদ-প্রচলিত বিশ্বাস এবং মৌখিক ঐতিহ্য। তিনি যেন মাটির বুক থেকে তুলে এনেছেন একেকটি সংস্কৃতির পাথর, যার ওপর নির্মিত হয়েছে তার কবিতার ভবন।

এ অধ্যায়ে আমরা বিশ্লেষণ করবো—কীভাবে জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যে লোকসংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়েছে, কীভাবে তিনি লোকগান ও গ্রামীণ কথনরীতিকে কাহিনিচিত্রে রূপান্তর করেছেন এবং এসব কীভাবে তাঁর কাব্যকে একটি জাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাসে পরিণত করেছে।

১. লোকসংস্কৃতির পরিভাষা ও চেতনা
লোকসংস্কৃতি বলতে বোঝায়—একটি অঞ্চলের সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবন, উৎসব, ধর্ম, রীতি, বিশ্বাস, লোককাহিনি, প্রবাদ, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, খেলাধুলা, গান ও গল্প—সব মিলিয়ে একটি সাংস্কৃতিক সত্তা। জসীম উদ্‌দীনের কবিতা এ সত্তার নিখুঁত প্রতিচ্ছবি। তিনি শহুরে রুচির পেছনে ছুটে যাননি বরং পল্লির ধানক্ষেত, দোলাচালিত নৌকা, কাঁথা সেলাই করা মেয়ে, কিংবা বৈশাখের রোদে পুড়ে যাওয়া রাখালকে তুলে ধরেছেন সাহিত্যের কেন্দ্রবিন্দুতে।

২. লোকগান ও লোকসংগীতের ব্যবহার
জসীম উদ্‌দীন নিজেই ছিলেন একজন লোকগীতি সংগ্রাহক ও গায়ক। দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে বয়স্কদের মুখ থেকে শুনে লিপিবদ্ধ করেন পল্লীগান, বাউল, ভাটিয়ালি, পুঁথি এবং সাধু-ভক্তিগান। তাঁর কাব্যে গানগুলো নতুন জীবন পায়। উদাহরণস্বরূপ:
‘পিঞ্জিরা খুলে দে মা, আমি আর থাকতে পারি না’—এটি একটি গীতিকবিতা হলেও এক ধরনের আত্ম-অন্বেষার লোকগান। ‘নাই দাদা ভাইরে নাই, রূপের জলের কলসি...’—শোকের গানে রূপকের ব্যবহার। গানগুলোতে আমরা পাই গ্রামের দুঃখ, নদীর ডাক, প্রেমিকার বেদনা, দেহতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিকতা।

৩. লোককাহিনি ও গল্পভিত্তিক কাব্য
জসীম উদ্‌দীনের অনেক কাব্য লোককাহিনির ছায়া থেকে জন্ম নিয়েছে। ‘নকশী কাঁথার মাঠ’—এমন একটি লোককাহিনির রূপক।
‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’—প্রেম ও সমাজের দ্বন্দ্বের এক মৌখিক গল্পকে কাব্যে রূপান্তর। তাঁর এসব কাহিনি সাধারণত:
> সরল, কিন্তু গভীর
> আবেগপূর্ণ, কিন্তু সমাজ-সচেতন
> দেশীয়, কিন্তু সর্বজনীন

৪. উৎসব, রীতি ও সামাজিক চিত্র
তাঁর কবিতায় বাংলার পল্লি-উৎসব ও আচার জীবন্তভাবে উপস্থিত:
নবান্ন—ধানের নতুন ফসল ঘরে ওঠার উৎসব
গায়ে হলুদ ও বিবাহ—পল্লির বর্ণময় বিবাহ সংস্কৃতি
ঈদ—পল্লির ঈদের আনন্দ, খুশি ও বঞ্চনা
চৈত্রসংক্রান্তি, রাখালি উৎসব, হালখাতা
মেলায় যাওয়া—যেমন ‘চরভাগার মেলা’। উদাহরণ:
‘চরভাগার মেলায় যাবে রূপাই,
সাজু চেয়ে রইলো সাঁঝের ওই পথে…’। এসব দৃশ্য কোনো বানানো ছবি নয়—সত্যিকারের মানুষের জীবন।

৫. লোকবিশ্বাস ও প্রথা
গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে—
‘বটগাছের ছায়ায় ভূত থাকে’
‘ভর করলে মানুষ গান গায়’
‘সোনার মোহর মাটির নিচে ঘুমিয়ে থাকে’
‘বিয়ের রাতে মৃত আত্মারা আসে আশীর্বাদ করতে’।
এসব বিশ্বাস তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে রূপক, উপমা ও প্রতীক হিসেবে। যেগুলো কাব্যের গভীরতা বাড়িয়েছে।

৬. কাহিনিচিত্র: দৃশ্যমান কবিতা
জসীম উদ্‌দীনের কবিতা পড়তে গিয়ে পাঠক যেন একটি চলচ্চিত্র দেখে। নকশী কাঁথা, চরভাগার মেলা, রাখালের কাঁধে বাঁশি, নদীর ঘাটে দাঁড়ানো সোজন—এসব দৃশ্য পাঠকের মনে ক্যামেরার দৃশ্যের মতো জীবন্ত হয়ে ওঠে। তাঁর শব্দচিত্রগুলো এতটাই প্রাণবন্ত যে, সেগুলোতে কেবল পাঠ নয়, দর্শন সম্ভব হয়।

৭. সাহিত্যিক মূল্যায়ন
সমালোচকদের মতে, জসীম উদ্‌দীন ছিলেন একজন লোক-ঐতিহ্যের সাহিত্যমূল্য আবিষ্কারক। তিনি দেখিয়েছেন, যা কিছু ‘লোকজ’, তা অমূল্য। তাঁর সাহিত্যচর্চা ছিল একধরনের সংস্কৃতি সংরক্ষণ অভিযান। তিনি সাহিত্যের ভাষায় একটি জাতির হৃদয়, গান ও ইতিহাস ধরে রেখেছেন।

জসীম উদ্‌দীনের গদ্যসাহিত্য: পল্লিজীবনের আরেকটি রূপ
পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীনকে প্রধানত কবি হিসেবেই চিনি—বিশেষ করে ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ কিংবা ‘সোজন বাদিয়ার ঘাটে’র মতো কালজয়ী কাব্যের জন্য। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না, তিনি শুধু একজন কবিই ছিলেন না, ছিলেন একজন দক্ষ গদ্যকারও। তাঁর গদ্যসাহিত্য—যেমন ভ্রমণকাহিনি, আত্মজৈবনিক রচনা, প্রবন্ধ, স্মৃতিচারণা ও গল্পতেও গ্রামবাংলার চিত্র অত্যন্ত জীবন্তভাবে ফুটে উঠেছে। এ অধ্যায়ে আমরা বিশ্লেষণ করবো—তাঁর গদ্য সাহিত্যের ধরন, ভাষারীতি, পল্লিজীবনের প্রতিফলন এবং সাহিত্যিক গুরুত্ব।

১. গদ্যসাহিত্যচর্চার শুরু ও প্রবণতা
জসীম উদ্‌দীনের গদ্য লেখার ঝোঁক শুরু হয় কাব্যচর্চার পাশাপাশি। যদিও তাঁর কবিতা বেশি জনপ্রিয়তা পায়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সচেতন পর্যবেক্ষক এবং মাটিঘেঁষা লেখক। ফলে তার গদ্যে আমরা পাই—
> গভীর আত্মজিজ্ঞাসা
> নস্টালজিয়া
> জীবনের রূঢ় সত্য
> লোকজ অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ
> এবং জাতিগত চেতনার প্রতি আবেগ।

২. ভ্রমণসাহিত্য: আসাম দেখা
জসীম উদ্‌দীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গদ্য ‘আসাম দেখা’। এটি শুধু একটি ভ্রমণ বিবরণ নয়, একসময়ের সামাজিক দলিল।
এ গ্রন্থে তিনি ১৯৪৪ সালে আসামে বেড়াতে গিয়ে দেখা জনজীবন, চা-বাগান, কৃষিকাজ, নদী, জাতিসত্তা, পাহাড়ি জীবন ইত্যাদি তুলে ধরেন। ভ্রমণকাহিনির মধ্যে রয়েছে- ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণ, সমাজচিত্র, স্থানিক আবেগ এবং একটি কবির চোখ দিয়ে দৃশ্য দেখা। তিনি লেখেন: ‘এই আসামের চা-বাগানের বালক রাখালের মুখেও আমি আমার দেশের গন্ধ পাই।’

৩. আত্মজৈবনিক রচনা ও স্মৃতিচারণ
জসীম উদ্‌দীনের আত্মজৈবনিক গদ্য লেখাগুলো বাংলা সাহিত্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন তাঁর শৈশব, শিক্ষাজীবন, সাহিত্যচর্চা, আত্মীয়-স্বজন, বাংলার মানুষ, এমনকি সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের সম্পর্কেও।
প্রধান রচনা:
ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়—রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের স্মৃতি
তারা তিনজন—তিনজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের কথা
এক পলল জীবন—জীবন দর্শন ও স্মৃতির সমাহার।
লেখাগুলোতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি জাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাস।

৪. প্রবন্ধ ও মতামত
জসীম উদ্‌দীন প্রবন্ধও লিখেছেন। তাঁর প্রবন্ধে ফুটে ওঠে—পল্লিসমাজের চিত্র, গ্রাম-শহরের ফারাক, শিক্ষানীতি নিয়ে মতামত, বাংলার সংস্কৃতি রক্ষার তাগিদ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত গভীর বিশ্লেষণ। তাঁর প্রবন্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি হলো—‘প্রকৃত বাংলাদেশ গ্রামে থাকে, শহরে তার ছায়া মাত্র।’

৫. ভাষারীতি ও গদ্যধারা
তাঁর গদ্যরীতিও কবিতার মতোই মোলায়েম, সহজবোধ্য এবং হৃদয়ছোঁয়া। কোনো জটিলতা নেই, আবার সাধারণ কথাও একধরনের শিল্পে পরিণত হয়েছে। তাঁর ভাষায় রয়েছে: ভাবের গভীরতা, আবেগের আন্তরিকতা, পল্লির গন্ধ, মরমি তত্ত্বের সুর।
উদাহরণ: ‘মানুষ যত বড় হয়, তত মাটির গন্ধ পায় না—আমি যত মাটিতে ফিরে তাকাই, তত নিজেকে খুঁজে পাই।’

৬. সাহিত্যিক গুরুত্ব ও অবদান
জসীম উদ্‌দীনের গদ্যসাহিত্য বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। তিনি সাহিত্যে তথাকথিত শহুরে চেতনার বাইরে গিয়ে, পল্লিভিত্তিক এক মানবিক দর্শন নির্মাণ করেন। তাঁর আত্মজৈবনিক গদ্য আমাদের কাছে ইতিহাসের পাঠ্যক্রম, তাঁর ভ্রমণকাহিনি স্থানিক সমাজতত্ত্ব আর তাঁর প্রবন্ধ আমাদের জাতিসত্তার দিগদর্শন।

মানবতা, দারিদ্র্য ও সমাজচেতনা: জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যদর্শন
পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীনের কবিতা ও গদ্য বাংলা সাহিত্যে শুধু পল্লিজীবনের ছবি আঁকার মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তাঁর সাহিত্যজুড়ে রয়েছে গভীর মানবিকতা, দারিদ্র্যের যন্ত্রণা এবং সমাজসংস্কারের তাগিদ। তিনি শুধু একজন শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন একজন সচেতন মননশীল চিন্তাবিদ, যিনি সাধারণ মানুষের বেদনা, বঞ্চনা এবং স্বপ্নের কথা নিজের কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন।

এ অধ্যায়ে আমরা বিশ্লেষণ করবো—জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যজগতে মানবিক চেতনা, দরিদ্রের প্রতি সহমর্মিতা ও সমাজব্যবস্থার প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

১. গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের প্রতি সহানুভূতি
জসীম উদ্‌দীনের কবিতার কেন্দ্রবিন্দু হলো গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ। তিনি তাঁদের দুঃখ-কষ্ট, হাহাকার, মমতা ও মর্যাদার চিত্র তুলে ধরেন। তাঁর কবিতায় গরিব কৃষক, রাখাল, জেলে, মাঝি, বিধবা, কন্যা—সবার জন্য রয়েছে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। উদাহরণ (নকশী কাঁথার মাঠ): ‘সাজু কাঁথা ফেলে রেখে মরে/ মাঠে পড়ে রহিল ধুলায় পড়ে...’
এখানে সাজুর শোক কেবল ব্যক্তিগত নয়, তা এক দরিদ্র নারীজীবনের প্রতীক, যে সমাজের কাছে উপেক্ষিত।

২. সমাজবিচার ও বিভেদের প্রতিবাদ
জসীম উদ্‌দীন সমাজে বিদ্যমান ধর্মীয় বিভাজন, জাতপাত, ধনী-দরিদ্র বৈষম্য এবং নারীর প্রতি বৈষম্য সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাঁর সাহিত্যে এসব বিষয়ে সরাসরি প্রতিবাদ না থাকলেও আবেগময় ও প্রতীকধর্মী প্রতিবাদ পাওয়া যায়। সোজন বাদিয়ার ঘাট কাব্যে মুসলমান সোজন ও হিন্দু দুলালীর প্রেম শুধু একটি ব্যক্তিগত ঘটনা নয়—তা দুই সম্প্রদায়ের মাঝে গড়ে ওঠা মানবিক সেতুবন্ধনের আবেদন। তিনি লিখেছেন: ‘ধর্ম যার যার, মানুষ সবার।’ একটি বাক্যে তাঁর অন্তর্মুখী মানববাদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

৩. শ্রমজীবী মানুষ ও জীবনসংগ্রাম
জসীম উদ্‌দীন শ্রমজীবী মানুষদের শুধু কাব্যে স্থান দেননি বরং তাদের জীবনের কঠোর বাস্তবতা তুলে ধরেছেন অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে। তাঁর কবিতায়: গরু চরানো রাখাল, ধানের গোলা বয়ে আনা দিনমজুর, বৃষ্টির রাতে কাঁপতে থাকা জেলে, সবাই যেন জীবন্ত চরিত্র। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এখানে রোমান্টিক নয়—বাস্তব, করুণ এবং মানবিক।

৪. মানবতাবাদ ও সার্বজনীন চেতনা
জসীম উদ্‌দীন ছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক ও উদার চেতনার কবি। তিনি মানুষের ধর্ম, জাত, শ্রেণি, পোশাক—সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে শুধু মানুষকে দেখতে চাইতেন। এ কারণে তাঁর কবিতায় বারবার উঠে আসে: প্রেম ও দয়া, সহানুভূতি, ক্ষমাশীলতা, ভ্রাতৃত্ববোধ। এ মানসিকতা তাঁকে করেছে মানবিক সাহিত্যের প্রতিনিধি।

৫. পরিবার, সমাজ ও মূল্যবোধ
তাঁর কবিতায় শুধু প্রেম বা বিচ্ছেদ নয়—আছে: মাতৃভক্তি, পিতৃস্নেহ, ভাই-বোনের সম্পর্ক, পারিবারিক দায়িত্ববোধ, গ্রামের সমষ্টিগত জীবনধারা। উদাহরণ: ‘তুই বিদেশ যাইবি ভাই, আমি থাকি গাঁয়ে রে...’। এ বাক্য শুধু ভাইয়ের বিদায়ে কষ্ট নয়, গ্রামীণ পরিবারভিত্তিক সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি।

৬. দারিদ্র্যবোধ ও আত্মমর্যাদা
জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যে দারিদ্র্য কখনো লজ্জার কিছু নয় বরং তা আত্মমর্যাদাবোধের সাথেই চলে। তাঁর দরিদ্র চরিত্রেরা আত্মসম্মানে বাঁচে, কাঁদে, কিন্তু মাথা নিচু করে না। এ আত্মসম্মানই তাঁর সাহিত্যকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম: জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্যচেতনা
পল্লীকবির সাহিত্যে শুধু পল্লিজীবনের চিত্র নয়, রয়েছে গভীর জাতীয়তাবাদী চেতনা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল আলো। বাংলা ভাষা, বাংলার মানুষ, তাদের সংগ্রাম ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা তাঁকে করেছে বাংলা সাহিত্যের এক অমরায়ণ পুরুষ। এ অধ্যায়ে আমরা বিশ্লেষণ করবো—জসীম উদ্‌দীনের লেখায় জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম কীভাবে ফুটে উঠেছে এবং কীভাবে তিনি তার সাহিত্যকে জাতির প্রেরণার উৎসে পরিণত করেছেন।

১. মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি
জসীম উদ্‌দীনের কবিতা ও গদ্যে মাতৃভাষার মর্যাদা সর্বোচ্চ। তিনি বিশ্বাস করতেন ভাষা হলো জাতির প্রাণ, মাটির গন্ধ এবং মানুষের আত্মার বহিঃপ্রকাশ। ‘বাংলা আমার প্রাণের ভাষা,/ যে ভাষায় গেয়ে বাঁচি আমি।’ তাঁর ভাষায় আমরা পাই মাতৃভূমির প্রতি গভীর প্রেম ও আত্মার স্পন্দন।

২. পল্লিজীবন ও জনমানস
জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্য পল্লিজীবনের বর্ণনা দিয়ে জাতীয় চেতনার ভিত গড়ে তোলে। তিনি দেখিয়েছেন, বাংলাদেশের জনমানস ও সংস্কৃতি কোথায় নিহিত—মাটির সঙ্গে মানুষের জীবনের বন্ধনে। ‘গাঁয়ের মাটি, গাঁয়ের মানুষ, গাঁয়ের গান,/ এই দেশ আমার প্রাণের স্বপ্নভূমি।’ এভাবেই তিনি দেশের আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করেন।

৩. সাম্রাজ্যবাদ ও বিরোধিতা
জসীম উদ্‌দীন ছিলেন সক্রিয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। তাঁর কবিতায় দেশপ্রেম কেবল আবেগ নয়, এটি ছিল আন্দোলনের হাতিয়ার। তাঁর কবিতায় বারবার উঠে এসেছে স্বাধীনতা, মুক্তি সংগ্রামের কথা। যদিও সরাসরি রাজনীতি করেননি, তবে তাঁর সাহিত্য ছিল দেশের জন্য এক অমোঘ আহ্বান।

৪. একাত্মতা ও মানবতার সমন্বয়
তিনি জাতীয়তাবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছেন কেবল সীমান্ত ও ধর্মভিত্তিক নয় বরং মানবতার সঙ্গে একাত্ম করে। ‘দেশ মানে মানুষ, মানুষ মানে দেশ,/ যেখানেই থাকি, প্রেম তারই নেশা।’ এ দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে করেন সব জাতির মানুষের বন্ধু।

৫. স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রাম
জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্য মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে প্রেরণার উৎস। তাঁর কবিতায় বাঙালির বীরত্ব, ত্যাগ ও ঐক্যের গল্প উঠে এসেছে।

পরিশেষ ও সামগ্রিক মূল্যায়ন: পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্য ও ভাববীক্ষণ
বাংলা সাহিত্যের এক অমর নক্ষত্র পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীনের জীবন ও সাহিত্যচর্চার গভীরতা, তার সামাজিক দায়িত্ববোধ, মানবতা ও পল্লিজীবনের প্রতি নিবেদন আমাদের সামনে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাঁর কবিতা, গদ্য, গান ও নাটকে আমরা পাই বাংলার গ্রামের গন্ধ, মানুষের রক্তস্রোত, সংগ্রাম ও স্বপ্নের আদর্শ মিশেল।

১. জীবন ও সাহিত্য একাত্ম
জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্য ছিল তাঁর জীবনেরই সঙ্গী, তাঁর আত্মার প্রকাশ। পল্লিজীবনের সুখ-দুঃখের গল্প তিনি তুলে ধরেছেন নিখুঁত বর্ণনায়। তাঁর লেখায় জীবনের বাস্তবতা কখনো কোমল, কখনো কঠোর কিন্তু সর্বদাই হৃদয়গ্রাহী।

২. পল্লি-সংস্কৃতির ধারক
তিনি বাংলা পল্লি সংস্কৃতিকে সাহিত্যের এক ঐশ্বর্যপূর্ণ রূপে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর ভাষা, ছন্দ ও আঞ্চলিক রীতি পল্লির জীবন ও সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করেছে। তাঁর সাহিত্য এখন শুধু সাহিত্য নয় বরং একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

৩. মানবতা ও সমাজ সচেতনতা
জসীম উদ্‌দীনের সাহিত্য মানবতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। দারিদ্র্য, শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট, সমাজের অবিচার তিনি অকপটে তুলে ধরেছেন। তাঁর সাহিত্য সমাজে আলো ছড়ানোর কাজ করেছে।

৪. জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম
তিনি মাতৃভাষা, মাতৃভূমি ও জাতীয়তা নিয়ে গভীর ভাবনা পোষণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের আগেও তাঁর সাহিত্য ছিল দেশের জন্য এক প্রেরণার উৎস।

৫. ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক স্থান
বাংলা সাহিত্যে জসীম উদ্‌দীনকে এক অনন্য স্থানে রাখা হয়েছে। তিনি পল্লি কবিতার স্থপতি, যিনি বাংলার দরিদ্র, সাধারণ মানুষের ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন, দেশ-জনম-ভাষার প্রেমে বদ্ধপরিকর ছিলেন।

রেফারেন্স ও গ্রন্থসূচি
১. প্রাথমিক উৎস ও জসীম উদ্‌দীনের রচনা
জসীম উদ্‌দীন, নকশী কাঁথার মাঠ (কাব্যগ্রন্থ), বিভিন্ন সংস্করণ
জসীম উদ্‌দীন, সোজন বাদিয়ার ঘাট (কাব্যনাট্য)
জসীম উদ্‌দীন, আসাম দেখা (ভ্রমণকাহিনি)
জসীম উদ্‌দীন, ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় (স্মৃতিচারণ)
জসীম উদ্‌দীন, এক পলল জীবন (আত্মজৈবনিক রচনা)

২. সমকালীন ও পরবর্তী সমালোচক ও গবেষক
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (অধ্যায়: পল্লীকবি জসীম উদ্‌দীন)
মুহাম্মদ এনামুল হক, বাংলা সাহিত্যে পল্লীকবিতার উত্থান
মঈনুদ্দীন আহমেদ, জসীম উদ্‌দীনের কাব্যচর্চা ও জীবন
ড. মোস্তাফা কামাল, বাংলা কবিতা ও সমাজ

৩. গবেষণা প্রবন্ধ ও নিবন্ধসমূহ
জসীমউদ্‌দীনের কবিতায় গ্রামীণ চেতনা ও লোকসংস্কৃতি, প্রকাশিত: বাংলা একাডেমি
পল্লীকবির ভাষা ও ছন্দ, সাহিত্য পত্রিকা, ২০১০

৪. অন্যান্য উৎস
লোকসংস্কৃতি ও গান: বাংলার লোকসঙ্গীত, প্রকাশক: বাংলাদেশ সরকার
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে পল্লীকবির অবদান, গবেষণা প্রতিবেদন।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।