তৈরি হয়নি ‘নেটওয়ার্ক’, সুফল মিলছে না দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ
প্রকাশিত: ০৯:২৩ এএম, ১৭ আগস্ট ২০২৫
দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার/ফাইল ছবি

পরিবেশ দূষণ রোধ ও ঢাকার চারপাশের নদীর পানির গুণগত মান উন্নয়নে দাশেরকান্দিতে আধুনিক সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (এসটিপি) চালু করেছে ঢাকা ওয়াসা। উদ্বোধনের দুই বছর পরও পয়ঃবর্জ্য শোধনাগারে পৌঁছানোর পাইপলাইন (নেটওয়ার্ক) তৈরি করা হয়নি। ফলে যে উদ্দেশ্যে এসটিপি স্থাপন করা হয়েছিল, তার সুফল মিলছে না।

নতুন পাইপলাইন তৈরিতে বিদেশি বিনিয়োগের আসায় প্রহর গুনছে ঢাকা ওয়াসা। অর্থায়ন হলে এসটিপির সঙ্গে তেজগাঁও, নিকেতন, বাড্ডা, বনানী, গুলশান (অংশ), রমনা, ইস্কাটন, নয়াটোলা, মগবাজার, ওয়্যারলেস, মৌচাক, আউটার সার্কুলার রোড, মহানগর হাউজিং, হাতিরঝিল, কলাবাগান ও ধানমন্ডির (আংশিক) পয়ঃবর্জ্যের পাইপলাইন তৈরি করা হবে। কিন্তু কবে নাগাদ এ বিনিয়োগ পাওয়া যাবে, তার সুনির্দিষ্ট কিছু বলতে পারছে না ওয়াসা।

এমন অবস্থায় এসটিপি সচল রাখতে হাতিরঝিল থেকে ময়লা পানি টেনে পরিশোধন করছে এসটিপি। পরে সে পানি আবার রামপুরা খালে ফেলছে ওয়াসা। এতে খালের পানির মান কিছুটা উন্নতি ঘটছে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম একক পয়ঃশোধনাগার এসটিপি স্থাপন করা হয়েছে, তার সুফল মিলছে না।

যেহেতু ঢাকার বড় একটি অংশের পয়ঃবর্জ্য হাতিরঝিলে পড়ছে, তাই হাতিরঝিল থেকে পানি টেনে দাশেরকান্দি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে তা পরিশোধন করে আবার রামপুরা খালে পরিষ্কার পানি ফেলা হচ্ছে।-ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইম্প্রুভমেন্ট প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ বদরুল আলম

পরিবেশবিদদের ভাষ্য, ওয়াসা যখন এসটিপি স্থাপনের কাজ শুরু করেছিল, একই সঙ্গে ওই এলাকাগুলোতে নেটওয়ার্ক বা সংযোগ দরকার ছিল। এটি করা হলে এখন দাশেরকান্দিকে খুঁড়িয়ে চলতে হতো না। তাই এখনো যত দ্রুত সম্ভব এসটিপির সংযোগগুলো নির্মাণ করতে হবে।

তৈরি হয়নি ‘নেটওয়ার্ক’, সুফল মিলছে না দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের

২০২৩ সালের ১৩ জুন দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম একক পয়ঃশোধনাগারটির কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। তিন হাজার ৪৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রায় ৬২ একর জমির ওপর এসটিপি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারি তহবিল থেকে এসেছে এক হাজার ১০৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। ঢাকা ওয়াসা থেকে এসেছে ১০ কোটি টাকা। চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে এসেছে দুই হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা।

ওয়াসার সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন ঢাকা শহরে প্রতিদিন দুই হাজার মিলিয়ন লিটার পয়ঃবর্জ্য উৎপন্ন হয়। তার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ শোধন করার কথা দাশেরকান্দি প্ল্যান্টে। কিন্তু সংযোগ তৈরি না করেই প্ল্যান্টটি উদ্বোধন করা হয়। এ কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ওয়াসার সাবেক এমডি তাকসিম এ খান। ৫ আগস্টের পর তিনি আত্মগোপনে।

দাশেরকান্দির সঙ্গে ওই এলাকাগুলোর সংযোগ স্থাপন প্রকল্পটি নিয়ে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ পেলেই তার আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হবে।- ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুস সালাম

প্রকল্পটি উদ্বোধনের দিন তাকসিম এ খান বলেছিলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় উৎপাদিত পয়ঃ শতভাগ পরিশোধনের জন্য নারায়ণগঞ্জের পাগলা, ঢাকার রায়েরবাজার, উত্তরা ও মিরপুরে আরও চারটি আধুনিক সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হবে।

তৈরি হয়নি ‘নেটওয়ার্ক’, সুফল মিলছে না দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের

রামপুরা ব্রিজ থেকে দাশেরকান্দির দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, রামপুরা ব্রিজ সংলগ্ন হাতিরঝিলের ভেতর রয়েছে ওয়াসার পাম্প। এখান থেকে পাম্পের সাহাজ্যে ময়লা পানি টেনে দাশেরকান্দি নেয় ওয়াসা। পরে প্ল্যান্টের ভেতর কয়েক স্তরে পানি থেকে ময়লা আলাদা করা হচ্ছে। আর পানি বড় নালা দিয়ে ফেলা হচ্ছে রামপুরা খালে।

জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই নেটওয়ার্ক ইম্প্রুভমেন্ট প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ বদরুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এসটিপি ও সংযোগ লাইন আলাদা দুটি প্রকল্প ছিল। এর মধ্যে এসটিপি প্রথমে স্থাপন করা হয়েছে। এখন সংযোগ লাইন স্থাপনে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগের তালাশ করছে ওয়াসা। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক ওয়াসার প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে। সংযোগ তৈরিতে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা দরকার।’

তিনি বলেন, ‘ওই অর্থায়ন নিশ্চিত হলে শহরের বাসাবাড়ির পয়ঃবর্জ্য একটি নির্দিষ্ট লাইনে এসটিপিতে যাবে। সেখানে বৃষ্টির পানি ঢোকার সুযোগ থাকবে না। আর এখন যেহেতু ঢাকার বড় একটি অংশের পয়ঃবর্জ্য হাতিরঝিলে পড়ছে, তাই হাতিরঝিল থেকে পানি টেনে দাশেরকান্দি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে তা পরিশোধন করে আবার রামপুরা খালে পরিষ্কার পানি ফেলা হচ্ছে।’

তৈরি হয়নি ‘নেটওয়ার্ক’, সুফল মিলছে না দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের

দাশেরকান্দির এসটিপি নিয়ে আইএমইডির মূল্যায়ন

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুসারে, ওই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর স্যুয়েজ পরিশোধন করে বালু নদীতে নিঃসরণ করা, যাতে পানি ও পরিবেশ দূষণ কমানো যায়। কিন্তু পাইপলাইন সংযোগ না থাকায় তা ব্যাহত হচ্ছে। তাই বিনিয়োগের সুবিধাগুলো সর্বাধিক করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুবিধাটি সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করা উচিত।

হাতিরঝিলকে পর্যুদস্ত করে প্ল্যানটি বসে আছে। তাই আমি মনে করি, দ্রুততম সময়ে পুরো মাস্টারপ্ল্যানটি শেষ করা উচিত। আর যাদের জন্য এ কাজে বিলম্ব হলো, বিলম্বের কারণে মানুষের দুর্ভোগ, জন-জল-জমি-বায়ুর দূষণ হলো তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।- বাপা সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব

জানতে চাইলে ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুস সালাম ব্যাপারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘দাশেরকান্দির সঙ্গে ওই এলাকাগুলোর সংযোগ স্থাপন প্রকল্পটি নিয়ে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ পেলেই তার আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হবে।’

কিন্তু সংযোগ স্থাপনের আগেই কেন এসটিপি প্রকল্প স্থাপন বা উদ্বোধন করা হলো তার কোনো উত্তর দেননি তিনি।

তৈরি হয়নি ‘নেটওয়ার্ক’, সুফল মিলছে না দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের

ওয়াসা দাশেরকান্দি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের নামে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহ-সভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টটা যে উদ্দেশ্যে করে করা হয়েছে, এখন কিন্তু তার কিছুই হচ্ছে না। এখন যেটা করা হয়েছে, হাতিরঝিলের ময়লা পানি তারা প্ল্যান্টে নিয়ে ট্রিটমেন্ট করছে। এতে খুবই আংশিক কাজ হচ্ছে। এর পুরো সুফলতা পাওয়া যাবে কবে, তা ওয়াসাই ভালো জানে।’

তৈরি হয়নি ‘নেটওয়ার্ক’, সুফল মিলছে না দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের

তিনি বলেন, ‘দাশেরকান্দি প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে আংশিক কাজ হয়েছে। অথচ শতভাগ নেটওয়ার্ক থাকবে এমন অঙ্গীকারের ভিত্তিতে এ প্রকল্পটি হাতিরঝিলের সঙ্গে ইন্টিগ্রেটেড করা হয়েছিল। এখন হাতিরঝিলকে পর্যুদস্ত করে প্ল্যানটি বসে আছে। তাই আমি মনে করি, দ্রুততম সময়ে পুরো মাস্টারপ্ল্যানটি শেষ করা উচিত। আর যাদের জন্য এ কাজে বিলম্ব হলো, বিলম্বের কারণে মানুষের দুর্ভোগ, জন-জল-জমি-বায়ুর দূষণ হলো তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’

এমএমএ/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।