রূপনগরের আগুনে হারিয়ে যাওয়া জীবনের খোঁজে স্বজনরা

জান্নাত শ্রাবণী
জান্নাত শ্রাবণী জান্নাত শ্রাবণী , সহ-সম্পাদক
প্রকাশিত: ০২:৪১ পিএম, ১৫ অক্টোবর ২০২৫
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ভিড় করছেন অগ্নিকান্ডে নিহতদের স্বজনরা, ছবি: মাহবুব আলম

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে আজ সকাল থেকেই ভিড়। তবে এটি কোনো সাধারণ ভিড় নয়-এখানে কেউ এসেছেন খোঁজে, কেউ প্রার্থনায়, কেউ আবার নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়তে। রূপনগরের ভয়াবহ কেমিক্যাল অগ্নিকাণ্ডের পর যেসব দেহ ঢাকা মেডিকেল মর্গে আনা হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই আর চেনার মতো নেই। পোড়া চামড়া, বিকৃত মুখ, গলে যাওয়া পোশাক-সবকিছু যেন সময়ের নিষ্ঠুর সাক্ষী হয়ে আছে। 

রুপনগরের আগুনে হারিয়ে যাওয়া জীবনের খোঁজে স্বজনরা

হাসপাতালের মর্গের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন কেউ ভাইয়ের ছবি হাতে, কেউ বাবার প্যান্টের অংশটুকু ধরে। কারও চোখে নেই অশ্রু, আছে কেবল এক ধরনের অবিশ্বাস, আমার প্রিয়জন কি সত্যিই নেই?

রুপনগরের আগুনে হারিয়ে যাওয়া জীবনের খোঁজে স্বজনরা

নিহতদের স্বজনদের এখন সনাক্তের কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। পুলিশ ও প্রশাসনের প্রতিনিধি দল তাদের ভোটার আইডির কপি নিচ্ছেন, যাচাই করা হচ্ছে ছবি।

রুপনগরের আগুনে হারিয়ে যাওয়া জীবনের খোঁজে স্বজনরা

অনেক দেহ এতটাই পুড়ে গেছে যে, চেনা সম্ভব নয়-তাই নেওয়া হচ্ছে ডিএনএ নমুনা। এই পরীক্ষার ফলাফল মিললে তবেই হস্তান্তর করা হবে লাশ স্বজনদের হাতে। কিন্তু সেই অপেক্ষা যেন অসহ্য হয়ে উঠছে অনেকের জন্যই।

রুপনগরের আগুনে হারিয়ে যাওয়া জীবনের খোঁজে স্বজনরা

মর্গের বাতাসে মিশে আছে পোড়া গন্ধ আর হাহাকার। মর্গের ভেতর কাজ করছেন স্বাস্থ্যকর্মী ও পুলিশের সদস্যরা। কেউ নম্বর লিখছেন ব্যাগের ওপর, কেউ আবার ট্যাগ লাগাচ্ছেন শনাক্ত করা দেহে।

রুপনগরের আগুনে হারিয়ে যাওয়া জীবনের খোঁজে স্বজনরা

বাইরে অপেক্ষায় স্বজনরা-প্রত্যেকে যেন মৃত্যুর দ্বারে দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে প্রিয়জনের একটুখানি চিহ্ন।

রুপনগরের আগুনে হারিয়ে যাওয়া জীবনের খোঁজে স্বজনরা

অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন আব্দুল্লাহ আল মামুন নামের এক টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার। মর্গে তার মরদেহ শনাক্ত করতে এসে কান্নায় ভেঙে পরেন নিহতের বড় বোন।

রুপনগরের আগুনে হারিয়ে যাওয়া জীবনের খোঁজে স্বজনরা

তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন, লাশটাও চোখে দেখলাম না। এই বাক্যের ভারে যেন স্থির হয়ে যায় সময়। কেমিক্যালের আগুন শুধু দেহ নয়, পুড়িয়ে দিয়েছে অসংখ্য পরিবারের সুখ, নিরাপত্তা আর ভবিষ্যৎ।

রুপনগরের আগুনে হারিয়ে যাওয়া জীবনের খোঁজে স্বজনরা

ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের তদন্ত টিম বলছে, দেহগুলোর অবস্থা এমন যে সরাসরি শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। তাই প্রতিটি লাশ থেকে নেওয়া হচ্ছে ডিএনএ নমুনা-যা স্বজনদের ডিএনএ’র সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে। এই প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হলেও এটিই এখন একমাত্র উপায়, যাতে ভুল সনাক্ত এড়ানো যায় এবং লাশ সঠিকভাবে হস্তান্তর করা সম্ভব হয়।

রুপনগরের আগুনে হারিয়ে যাওয়া জীবনের খোঁজে স্বজনরা

এদিকে অনেক পরিবারই অপেক্ষায় দিন গুনছেন, যেন যত দ্রুত সম্ভব প্রিয়জনের শেষ দেখা পান। প্রতিটি এমন অগ্নিকাণ্ড আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শহরের অগোছালো, ঝুঁকিপূর্ণ জীবন কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। রুপনগরের কেমিক্যাল গোডাউনের এই আগুনও সেই একই চিত্র-নিয়মহীনতা, অবহেলা আর মানুষের জীবনের অমূল্যতা নিয়ে প্রশাসনের দীর্ঘ নীরবতা।

রুপনগরের আগুনে হারিয়ে যাওয়া জীবনের খোঁজে স্বজনরা

সকাল গড়িয়ে বিকেল। মর্গের ভেতর থেকে একে একে বেরিয়ে আসছে দেহগুলো। সাদা কাপড়ে ঢাকা, পাশে নম্বর লেখা। স্বজনরা এগিয়ে যাচ্ছেন-কেউ চিনতে পারছেন, কেউ পারেন না। ডিএনএ টেস্ট শেষে যখন লাশ হাতে পাবেন, তখন হয়তো সান্ত্বনা মিলবে-কিন্তু যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা আর পূরণ হবে না কোনোদিন।

রুপনগরের আগুনে হারিয়ে যাওয়া জীবনের খোঁজে স্বজনরা

ঢাকা মেডিকেলের মর্গের বাতাসে আজ শুধু পোড়া গন্ধ নয়, মিশে আছে এক শহরের নীরব কান্না।

জেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।