এক বছরেও দেয়া হয়নি চার্জশিট


প্রকাশিত: ০৩:০৩ এএম, ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

আজ ৬ ফেব্রুয়ারি। এই দিনে গাইবান্ধা সাহাপাড়া ইউনিয়নের তুলসীঘাট বাজার সংলগ্ন বুড়িরঘর এলাকায় যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা হামলায় শিশু ও নারীসহ ৮ জন অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। ওই ঘটনায় আগুনে পুড়ে আরও অন্তত ৪০ জন আহত হন। আহতরা চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠলেও দেহে আগুনের ক্ষত এখনও লেগে আছে। তাদের কেউ কেউ চরম আর্থিক সঙ্কটে দুর্বিষহ দিন কাটাচ্ছেন।

এ ঘটনার এক বছর পার হলেও আদালতে চার্জশিট দাখিল করতে পারেনি পুলিশ। অপরদিকে অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহতদের পরিবারগুলোর কান্না এখনও থামেনি।

২০১৫ সালে বিএনপি-নেতৃত্বাধীন জামায়াতসহ ২০ দলের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে ৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাতে সদর উপজেলার সাহাপাড়া ইউনিয়নের গাইবান্ধা-পলাশবাড়ি সড়কের তুলসীঘাটে বুড়ির ঘর এলাকায় ঢাকাগামী নাপু এন্টারপ্রাইজের নৈশ কোচ অবরোধকারীদের পেট্রলবোমা হামলার শিকার হয়। ওই নৈশকোচটি সুন্দরগঞ্জের পাঁচপীর বাজার থেকে রাত পৌনে ১১টার দিকে বুড়ির ঘর এলাকায় পৌঁছালে দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পেট্রলবোমায় ভস্মীভূত হয়ে যায়। আগুনে পুড়ে  ঘটনাস্থলেই নিহত হন সদরের মালিবাড়ি ইউনিয়নের আব্দুল গফুর মিয়ার ছেলে আবুল কালাম আজাদ (৩০), খোলাহাটি ইউনিয়নের পশ্চিম কোমরনই গ্রামের জিলহজ আলী (৩৫),  সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ কালীর খামার গ্রামের খয়বর হোসেন দুলুর ছেলে সৈয়দ আলী (৪২), পশ্চিম সীচা গ্রামের সাইব মিয়ার মেয়ে হালিমা বেগম (৪২), চন্ডিপুর গ্রামের শাজাহান আলীর ছেলে সুমন মিয়া (২২) এবং ওই গ্রামেরই বলরাম দাসের মেয়ে শিল্পী রাণী দাস (১০)। এছাড়া রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চন্ডিপুর গ্রামের তারা মিয়ার ছেলে সুজন মিয়া (১০) ও স্ত্রী সোনাভান বিবি (৪৫)।

পেট্রলবোমায় অগ্নিদগ্ধের ঘটনায় গাইবান্ধা সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলার বাদী হন সদর থানার এএসআই সফিউর রহমান। ওই মামলায় বিএনপি জামায়াতের ৬০ নেতা কর্মীর নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত পরিচয় ২৮-৩০ জনকে আসামি করা হয়।  

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই হাবিবুর রহমান ঘটনার সঙ্গে জড়িত শিবির কর্মী রেজানুর রহমান রূপক ও তাসকিনুল ইসলাম স্বপনকে গ্রেফতার করেন এবং পরবর্তীতে তারা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলে মূল ঘটনা বেরিয়ে আসে।

এসআই হাবিবুর রহমান হাবীব জানান, ওই মামলায় এ পর্যন্ত ৩২ জন জামায়াত শিবির কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলার প্রধান আসামি শিবির ক্যাডার মোস্তফা মঞ্জিল ওই ঘটনার কয়েকদিন পরই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।

ঘটনার পর এক বছর পার হলেও আদালতে মামলাটির চার্জশিট দাখিল না করায় কবে মামলাটির নিষ্পত্তি হবে এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল।

এলাকা ঘুরে জানা গেছে, নিহত সৈয়দ আলী কঞ্চিবাড়ি ইউনিয়নের কালির খামার গ্রামের দুলা মিয়ার ছেলে। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে, মাকে নিয়ে ছিল সৈয়দ আলীর সংসার। রিকশা চালানোর উদ্দেশ্যে ঢাকা যাচ্ছিল সৈয়দ আলী। চন্ডিপুর ইউনিয়নের পশ্চিম সীচা গ্রামের শাহাব উদ্দিনের স্ত্রী হালিমা বেওয়া নাতিকে নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন বুয়ার কাজ করার জন্য। এক ছেলে আর এক মেয়ে হালিমা বেওয়ার। ছেলে-মেয়েদের অভাব অনটনের সংসারে দু’মুঠো অন্নের যোগান না হওয়ায় দীর্ঘ দিন থেকে ঢাকায় বুয়ার কাজ করে আসছিলেন হালিমা। চন্ডিপুর ইউনিয়নের প্রাক্তন মেম্বার শাহজাহান মিয়ার বড় ছেলে সুমন। রং মিস্ত্রির কাজ করত তিনি। ছোট ভাই সুজন রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছে। তাকে খোঁজার জন্য চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন সুমন মিয়া। ভাইকে খুঁজতে গিয়ে নিজেই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। দুই ভাই এক বোন, বাবা-মা নিয়ে ছিল সুমনের সংসার। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সুমন। চন্ডিপুর ইউনিয়নের চন্ডিপুর গ্রামের বলরাম চন্দ্রের শিশু কন্যা শিল্পী রানী। ঢাকার নারায়ণগঞ্জে আলু ক্ষেতে কাজ করার জন্য মা-বাবার সঙ্গে ঢাকায় যাচ্ছিল শিল্পী। কিন্তু ঢাকায় যাওয়া হলো না তার লাশ হয়ে ফিরতে হল বাড়িতে। এক ভাই আর দুই বোনের মধ্যে শিল্পী ছিল সবার ছোট।

চন্ডিপুর ইউনিয়নের ফারাজিপাড়া গ্রামের তারা মিয়ার ছেলে সুজন, কন্যা তানজিনা ও স্ত্রী সোনাভানকে নিয়ে কর্মের সন্ধানে যাচ্ছিল ঢাকায়। পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সুজন ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সোনাভান। সীচা গ্রামের আব্দুল কাদেরের ছেলে সাজু মিয়া কর্মের সন্ধানে যাচ্ছিল ঢাকা। পেট্রলবোমায় দগ্ধ হয়ে অবশেষে হাসপাতালে মারা যায় সাজু। সংসারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি সৈয়দ আলীকে হারিয়ে তার স্ত্রী এখন অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করছে। বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা। স্ত্রী ছেলেকে হারিয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছে তারা মিয়া। মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া শিশু কন্যা তানজিনাকে নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন তারা মিয়া। শিশু কন্যা শিল্পীকে হারিয়ে এখনো কাঁদছেন বলরাম ও তার স্ত্রী। কর্মক্ষম ছেলে সুমনকে হারিয়ে বাবা শাহজাহান মিয়া এখন সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছেন। সব মিলিয়ে হতাহতদের পরিবারগুলো খুব বেশি ভালো নেই। এতো কষ্টের পরও শাহজাহান মিয়ার দাবী হত্যাকারীরা যেন উপযুক্ত শাস্তি পায়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই হাবিবুর রহমান জানান, মামলার তদন্ত কার্যক্রম একেবারে শেষ পর্যায়ে। ওই ঘটনায় নিহত ও আহতদের মেডিকেল প্রতিবেদন পেতে দেরি হওয়ায় আদালতে চার্জশিট দিতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তবে চলতি মাসেই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।

অমিত দাশ/এসএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।