৫১ বছর বয়সেও দিব্যি ফুটবল খেলে যাচ্ছেন মোহাম্মদ আলী
আরিফ খান জয়, জুয়েল রানা, মাসুদ রানা, হাসান আল মামুন, আলফাজ, আরমান মিয়া, রজনী, বিপ্লব, নজরুল, টিটুরা বুট তুলে রেখেছেন অনেক আগেই। অথচ তাদের সঙ্গে খেলা গোলরক্ষক মোহাম্মদ আলী এখনও দিব্যি খেলে যাচ্ছেন প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল। আগামী ৩ অক্টোবর ৫২ বছরে পা দেবেন মোহাম্মদ আলী। তবুও ফুটবলকে এখনই বিদায় বলতে চান না। তার আশা ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত ফুটবল খেলে যাওয়ার।
গোলপোস্টের নিচে এখনও তার যে মুভমেন্ট, ফুটবলের প্রতি তার যে ভালোবাসা এবং তার ফিটনেস দেখে কিছুতেই মনে হবে না মোহাম্মদ আলীর বয়স ৫১ বছর পার হয়ে গেছে। তিনি যে শখের ফুটবল খেলে যাচ্ছেন তাও কিন্তু না। ১৯৯৩ সাল থেকে দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলই খেলে যাচ্ছেন নারায়নগঞ্জের এই মোহাম্মদ আলী।
১৯৯৩ সালে প্রথম বিভাগের দল ধানমন্ডি ক্লাব দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক ফুটবলে অভিষেক মোহাম্মদ আলীর। সেই যে শুরু, আর পেছনে ফেরেননি তিনি। তার সময়কার ফুটবলাররা বুট খুলে রেখে কেউ মন্ত্রী হয়েছেন, কেউ কোচ হয়েছেন, কেউ সংগঠক হয়েছেন, কেউ ব্যবসায়ী হয়েছেন, কেউ অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন; কিন্তু মোহাম্মদ আলী ফুটবলারই রয়ে গেছেন। বর্তমানে খেলছেন প্রথম বিভাগের দল যাত্রাবাড়ী ক্রীড়া চক্রে।
তিনি যে বছর ধানমন্ডি ক্লাবে খেলা শুরু করেন, পরের বছরই দেশে শুরু হয় প্রিমিয়ার লিগ। ধানমন্ডিতে এক বছর প্রিমিয়ারে খেলে পরের বছর যোগ দেন বিআরটিসি ক্লাবে। সেখানে খেলেন টানা ৫ বছর। পরের তিন বছর রহমতগঞ্জে খেলে যোগ দেন ব্রাদার্স ইউনিয়নে। গোপীবাগের ক্লাবে টানা ৫ বছর খেলে যোগ দিয়েছিলেন সিলেটের বিয়ানীবাজার ক্লাবে।

২০০৭ সালে দেশে প্রবর্তন হয় পেশাদার ফুটবল। পেশাদার ফুটবলের প্রথম দুই বছর খেলেন প্রিমিয়ার লিগের সবচেয়ে সফল দল আবাহনীতে। তিনি আবাহনীর প্রথম দুইবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া দলের গর্বিত সদস্য। আবাহনীতে দুই মৌসুম খেলে মোহাম্মদ আলী যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধায়। সেখানে এক বছর খেলে পরের দুই বছর ফরাশগঞ্জে।
২০১৩ সালে আবার নাম লেখান প্রথম বিভাগ লিগে। স্বাধীনতা ক্রীড়া সংঘে এক বছর খেলে ২০১৩ সালে যোগ দেন পেশাদার ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের দল ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবে। তার ক্লাব রানার্সআপ হয়ে প্রিমিয়ার লিগে উঠলেও তিনি থেকে যান চ্যাম্পিয়নশিপ লিগেই। খেলেন ইয়ংমেন্স ক্লাব ফকিরেরপুলে। পরের মৌসুমে ফরাশগঞ্জ আবার চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে নেমে গেলে আলী যোগ দেন সেই ক্লাবে। এভাবে ২৯ বছর ধরে দেশের শীর্ষ পর্যায়ের লিগ খেলছেন বিভিন্ন ক্লাবের জার্সিতে।
গায়ের রঙ কালো। সুঠাম দেহ। অনেকে তাকে নাইজেরিয়ান ফুটবলার ভেবে ভুল করেন। এমন কি বিদেশে যাওয়ার সময় ইমিগ্রেশন অফিসার তাকে আলাদা খাতিরও করেন বিদেশি মনে করে। আলী মাঝেমধ্যে বলতেন, আমি বাংলাদেশী হয়েও কখনো কখনো বিদেশি হয়ে যাই। মজার বিষয় হলো তিনি কিন্তু নাইজেরিয়ান বংশোদ্ভূত বাংলাদেশিই। কারণ, মোহাম্মদ আলীর নানা ছিলেন একজন নাইজেরিয়ান। তার নানা কিভাবে বাংলাদেশে এসেছিলেন সে গল্প শোনা যাক।
অনেক দিন আগের কথা। নাইজেরিয়ার একটি সার্কাস দলের সদস্য হয়ে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) এসেছিলেন আলীর নানা। কিন্তু তিনি আর দেশে ফিরে যাননি। নারায়নগঞ্জেই থেকে যান। কিছুদিন পর বিয়েসাদী করে সংসার পেতে চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছিলেন। সে নাইজেরিয়ানের মেয়ের ঘরের নাতী মোহাম্মদ আলী এখন দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সী ফুটবলার।
বুধবার কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে ফ্রেন্ডস সোস্যাল ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশনের বিপক্ষে ম্যাচ শুরুর আগে মোহাম্মদ আলীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আর কতদিন খেলতে চান? হেসে মোহাম্মদ আলীর জবাব, ‘যতদিন শরীরে কুলায় ততদিন ফুটবল খেলে যাবো। খারাপ তো খেলছি না। আমার ইচ্ছা আছে ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত ফুটবল খেলার।’

আলীর নামের সঙ্গে তার নাইজেরিয়ান নানার নামেরও মিল আছে। নিজের বাবার নামের সঙ্গে মিলিয়ে ছেলের নাম রেখেছিলেন আলীর মা। ওই নাইজেরিয়ানের নাম ছিল ববে আলী। নাতীর নাম দেন মোহাম্মদ আলী।
দীর্ঘ ২৯ বছর মোহাম্মদ আলীর ফুটবল খেলে যাওয়া অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। ব্যক্তিগত জীবনে ৩ সন্তানের জনক তিনি। দুই মেয়ে বড়। তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ছেলে সবার ছোট। আলীর খেলে যাওয়ার বিষয়টি বাসার মানুষগুলোর কাছেও ভালো লাগার। পরিবারের সদস্যদের সমর্থন পাওয়া মোহাম্মদ আলী আর কতদিন গোলপোস্টের নিচে বুক চিতিয়ে খেলেন সেটাই এখন দেখার।
আরআই/আইএইচএস/