‘দান দান তিনদানে’ ভাগ্য খুলবে টাইগারদের?
‘দান, দান তিনদান।’ এটাকে প্রবচন বলা যাবে না। তবে এমন একটি কথা প্রচলিত আছে অনেকদিন। যার আভিধানিক অর্থ হলো- কোন একটি কাজ আগের দুবার হয়নি বা টানা দ্বিতীয়বারের চেষ্টায়ও সফলতা আসেনি। তৃতীয়বারের চেষ্টায় হয়তো সাফল্যের দেখা মিলবে। আর সেই বোধ ও উপলব্ধি থেকেই বলা হয় ‘দান দান তিনদান।’
ভারতের সাথে ঐতিহাসিক সেমির লড়াইয়ের আগে সেই চলতি কথাটি অনেকেরই মনে আসছে। গত দুদিন ক্রিকেটপাড়ায় অনেককেই বলতে শোনা গেছে, ‘শুধু মাশরাফি, তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ আর মোস্তাফিজরা ভালো খেললেই চলবে না- ভারতের সাথে ভাগ্যও পক্ষে থাকতে হবে। আগের দুবার সম্ভাবনা জাগিয়েও পারিনি আমরা। শেষ পর্যন্ত হারই সঙ্গী থেকেছে। কাজেই এবার যেন ভাগ্য সহায় থাকে।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কেউ কেউ তেমন কথা লিখেছেন। শুধু ভক্ত-সমর্থকদের কথা বলা কেন, ভারতের সাথে সেমির যুদ্ধে এমকি ভাগ্যের আনুকূল্যের আশায় খোদ বাংলাদেশ কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহেও।
চরম পেশাদার মানসিকতার হাথুরুও অবচেতন মনে চিন্তা করতে শুরু করেছেন, কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে হারাতে শুধু ভালো খেলা আর ব্যাটিং ও বোলিং, ফিল্ডিংয়ে সামর্থ্যের সেরাটা উপহার শেষ কথা নয়- ভাগ্যও সহায়ক থাকতে হবে।
তার ভাবনায় ঢুকে গেছে ‘ভাগ্যও’ একটা নিয়ামক। ভালো খেলার পাশাপাশি সাফল্যের পিছনে ভাগ্যর সহায়তাও প্রয়োজন। তাই তো এবার ভারতের বিরুদ্ধে খেলায় ভাগ্যের আনুকূল্য চান বাংলাদেশ কোচ।
তার চিন্তায়ও এসেছে, আগের দুবার ভারতের সাথে জয়ের সম্ভাবনা তৈরি করেও শেষ রক্ষা হয়নি। ভাগ্য অনুকূলে ছিল না তাই। এবার ১৫ জুন বার্মিংহ্যামের এজবাস্টনের সেমির যুদ্ধে তাই ভাগ্যের আনুকূল্য কামনা করছেন হাথুরু। গতকাল বার্মিংহ্যামে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের সাথে আলাপে তার কথা, আবারও বিশ্ব আসরের নকআউট পর্বে ভারতের সাথে দেখা। দেখা যাক এবার তৃতীয়বার যখন, তখন ভাগ্য আমাদের সাথে থাকতেও পারে।’
বলার অপেক্ষা রাখে না, গত দুই বছর ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে দুবার ভারতকে হারানোর সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে বাংলাদেশের। প্রথমবার ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। আর দ্বিতীয়বার ২০১৬ সালের বিশ্ব টি-টোয়েন্টি আসরে।
বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্ত ও সমর্থকদের বড় অংশের বদ্ধমূল ধারণা ও স্থির বিশ্বাস, আম্পায়ার আলিমদার (পাকিস্তানি), ইয়ান গোল্ড এবং টিভি আম্পায়ার এস জে ডেভিসের (ইংলিশ) দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ সিদ্ধান্তর কারণেই প্রথমবার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে হারে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালের ১৯ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে ভারতের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপে প্রথমবার কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে বাংলাদেশ সত্যিই ভাগ্যের আনুকূল্য পায়নি।
আম্পায়ারের নেয়া দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বিপক্ষে গেছে। আর টিভি আম্পায়ারও পর্যাপ্ত আধুনিক উপকরণ হাতে থাকার পরও তার যথাযথ ব্যবহার করেননি। তারও মাশুল দিতে হয়েছে। দুই ওপেনার রোহিত শর্মা আর শিখর ধাওয়ান ১৬.৩ ওভারে ৭৫ রান তুলে ভারতকে একটা শক্ত ভীতের ওপর দাঁড় করালেও তারপর ম্যাচে ফেরে বাংলাদেশ।
ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীল ব্যাট চালনা রুদ্ধ হয়। ওভার পিছু রান তোলার গতিও যায় কমে। তাই তো ২৫ ওভার শেষে ধোনি বাহিনীর রান ছিল ২ উইকেটে ৯৯। ওভার পিছু রান উঠেছিল ৩.৯৬ করে। ৩০ ওভার শেষেও ভারতের রান তোলার গতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা।
৩০ ওভার শেষে ভারতের রান ছিল ৩ উইকেটে ১২৬ (ওভার পিছু ৪.২০)। এমনকি ৩৯ ওভার শেষেও ভারতের ওভার পিছু রান তোলার গতি ছিল পাঁচের কম (৪.৯৭)। শেষ ১১ ওভারে ঝড়ো ব্যাটিংয়ে প্রতি ওভারে ৭ থেকে ৮ রান করে তুললেও ভারতের পক্ষে ২৭০ পার হওয়া কঠিন ছিল; কিন্তু সেটা গিয়ে ঠেকল ৩০২-এ।

রোহিত শর্মার ১২৭ রানের দীর্ঘ ইনিংসই ভারতকে ৩০০’র ঘরে নিয়ে যায়। অথচ ৯০ রানে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল রোহিতের। বাংলাদেশের পেসার রুবেল হোসেনের বলে। ফুলটচ ডেলিভারিতে ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়েছিলেন রোহিত শর্মা; কিন্তু আম্পায়ার আলিমদারের মনে হলো বল কোমর উচ্চতার ওপরে ছিল। তাই ‘নো বল’ ডাকা হলো। থার্ড আম্পায়ারের কাছে পাঠানো হলো রিভিউ করতে। টিভি রিপ্লে দেখে টিভি আম্পায়ার এস জে ডেভিসেরও মনে হলো বল রোহিত শর্মার কোমরের ওপর ছিল।
এরপর বাংলাদেশ ইনিংসেও আম্পায়ার ও টিভি আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত বিপক্ষে গেল। দুই ওপেনার তামিম আর ইমরুল কায়েস ফিরে যাওয়ার পর শক্ত হাতে হাল ধরে এগোচ্ছিলেন সৌম্য সরকার আর মাহমুদউল্লাহ; কিন্তু জুটিতে ৪০ রান যোগ হওয়ার পর আউট মাহমুদউল্লাহ। ভারতের পেসার মোহাম্মদ সামির খাট লেন্থের ডেলিভারিকে পুল করতে গিয়ে মিড উইকেটে শিখর ধাওয়ানের হাতে ক্যাচ দিলেন মাহমুদউল্লাহ।
সীমানার ঠিক ওপর দাঁড়িয়ে তা ধরে ফেললেন ভারতীয় ফিল্ডার শিখর ধাওয়ান। মনে হচ্ছিল তার পা সীমানা দড়ি স্পর্শ করেছে। টিভি রিপ্লের কোনো কোনো এঙ্গেলে তাই মনে হলো; কিন্তু ঠিক যে জায়গায় শেখর ধাওয়ানের পা ছিল, সেখানে ক্যামেরা জুম করে দেখলেই হয়তো বিষয়টি পরিষ্কার হতো; কিন্তু তা না করায় বিষয়টা ধোঁয়াশেই থেকে গেল। বাংলাদেশ হারল ১০৯ রানে।
গত বছর বিশ্ব টি-টোয়েন্টির গ্রুপ ম্যাচে ভারতকে মুঠোয় পেয়েও হারাতে না পারার দুঃখ এখনও পোড়ায়। ভারতীয়দের তোলা ১৪৬ রানের পিছু ধাওয়া করে নিশ্চিত জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছিল মাশরাফির দল; কিন্তু শেষ ওভারে চার উইকেট হাতে রেখে ১১ রান করা সম্ভব হয়নি।
মুশফিকুর রহীম ও মাহমুদউল্লাহ প্রথম তিন বলে ৯ রান তোলার পর হঠাৎ ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়ে বাংলাদেশ। ভারতীয় পেসার হারদিক পান্ডিয়ার শেষ তিন বলে দুই রান তুলতে গিয়ে উল্টো ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেট আর লংঅনের মাঝামাঝি ক্যাচ দিলেন মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ।

যার একটি ছিল ফুলটচ আর অন্যটি শর্ট পিচ। ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে ভারতীয়দের বাগে পেয়েও হারাতে না পারা অবশ্যই অদুরদর্শি ও উচ্চাভিলাষি ব্যাট চালনার চড়া মাশুল। পাশাপাশি কেউ কেউ ভাগ্যকেও দুষছেন। তাদের কথা, মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ ফুলটচ ও খাটো লেন্থের বলকে চার ও ছক্কা হাঁকানোর চেষ্টা না করে সোজা ব্যাট মাটিতে রেখে খেললেই দুটি সিঙ্গেল হয়ে যেত। তাহলে জয়ের দেখা মিলত।
কেউ কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলবেন, আম্পায়ার-টিভি আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের পর মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর ব্যর্থতা। এর সাথে ভাগ্যকে জড়ানো কেন? জবাব একটাই- ভাগ্য পক্ষে থাকলে হয়তো বিপক্ষে যাওয়া ঘটনাগুলো টাইগারদের পক্ষে থাকত। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তও হয়তো পক্ষে আসত। আর মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর ওই শট ক্যাচের বদলে বাউন্ডারি হলেই হয়তো জয়ের দেখা মিলত।
তাইতো বৃহস্পতিবারের ম্যাচে ভাগ্যের আনুকূল্যর আশায় কোচ হাথুরুসিংহে। দেখা যাক এবার তিনবারের বেলায় ভাগ্য টাইগারদের পক্ষ নেয় কি না!
এআরবি/আইএইচএস/