শহীদ সিরাজুল ইসলামের যে চিঠি শিহরণ জাগায়


প্রকাশিত: ০২:৫৯ এএম, ০৮ আগস্ট ২০১৬

১৯৭১ সাল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে বাঙালি দামাল ছেলেরা। এ সময় সিরাজুল ইসলাম ১৯ বছরের টগবগে যুবক। কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র। কিন্তু লেখাপড়ায় মন বসছিল না তার। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতার জন্য লড়ছেন লাখো মানুষ। তাই মুক্তির স্বপ্নে বই-খাতা ফেলে ঘর ছাড়েন সিরাজুল ইসলাম।

মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে ভারতের আসামে ইকোয়ান ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে ৫ নং সেক্টরের অধীনে সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে। সাচনা যুদ্ধ ছাড়াও সিলেট ও সুনামগঞ্জ এলাকায় অনেক যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন সিরাজুল ইসলাম।

১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট। সুনামগঞ্জের সাচনা হানাদার মুক্ত করতে রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধে লড়ছে শহীদ সিরাজের নেতৃত্বে একদল মুক্তিসেনা। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণে ৩৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। এক পর্যায়ে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে সাচনা বন্দর শক্রমুক্ত হয়।

কিন্তু যুদ্ধ শেষে পলায়নরত পাকসেনাদের কাভারিং ফায়ারের একটি বুলেট শহীদ সিরাজের কপালে বিদ্ধ হলে তিনি গুরুতর আহত হন। মিত্র বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ভারত নেয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে টেকেরঘাটে খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়। আর তাই আজকের দিনটিই হচ্ছে শহীদ সিরাজুল ইসলাম বীর প্রতীকের মৃত্যুবার্ষিকী।

শহীদ সিরাজুল ইসলামের রক্তে ছিল মুক্তির নেশা। তাইতো মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে ১৯৭১ সালের ৩০ জুলাই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তিনি বাবার কাছে একটি চিঠি লিখেন। ওই চিঠিটিই হয়ে উঠে মুক্তি পাগল যোদ্ধাদের ত্যাগ আর দেশের প্রতি ভালোবাসার কালজয়ী নিদর্শন।

কালজয়ী সেই চিঠি :

বাবার কাছে লেখা সিরাজুল ইসলামের চিঠিটি ছিল, ‘বাবা, আমার সালাম নিবেন, আশা করি খোদার কৃপায় ভালই আছেন। বাড়ির সকলের প্রতি আমার শ্রেণিমত সালাম ও স্নেহ রহিল। আলীরাজ, রওশন, মাতাব, রনু, ইব্রাহীম, ফুল মিয়া সকলেই একত্রে আছি।

দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করিয়াছি। আমার জন্য ও দেশ স্বাধীন হওয়ার জন্য দোয়া করবেন। আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি। কারণ দেশ স্বাধীন না হইলে জীবনের কোন মূল্য থাকিবে না। তাই যুদ্ধই জীবনের পাথেয় হিসাবে নিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদের ক্ষমা করিব না। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করিতে হইবে।

চাচা, মামাদের ও বড় ভাইয়ের নিকট আমার সালাম। বড় ভাইকে চাকরিতে যোগদান করিতে নিষেধ করিবেন। জীবনের চেয়ে চাকরি বড় নয়। দাদুকে দোয়া করিতে বলিলেন। মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোন সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।

দোয়া করবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখিবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্র হারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন। আর আমার জন্য চিন্তার কোন কারণ নেই। আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তবেই আপনার সাধ মিটে যাবে।

kishoreganj

দেশবাসী স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য দোয়া কর। মীর জাফরী করিও না। কারণ মুক্তি ফৌজ তোমাদের ক্ষমা করিবে না এবং বাংলায় তোমাদের জায়গা দিবে না। সালাম, দেশবাসী সালাম।’

ইতি
মো. সিরাজুল ইসলাম
৩০.০৭.১৯৭১

১৯৫২ সালে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ছিলনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শহীদ সিরাজুল ইসলাম। বাবার নাম মরহুম মকতুল হোসেন ও মা গফুরুন্নেছা।

দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সরকার শহীদ সিরাজকে বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করে। সাচনা নদী বন্দরের নামকরণ করা হয় সিরাজনগর।

তার স্মরণে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়। ইটনা উপজেলা সদরে ধনু নদীর উপর  একটি সেতুর নামকরণ করা হয়েছে তার নামে।

এদিকে, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টেকেরঘাটে অবস্থিত শহীদ সিরাজের কবরটি অযত্ন-অবহেলায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে সেটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই।

শহীদ সিরাজুল ইসলামের ভাতিজা অ্যাডভোকেট মারুফ আহমেদ জানান, শহীদ সিরাজুল ইসলামের শাহাদাৎ বার্ষিকী পালন উপলক্ষে কিশোরগঞ্জের ইটনা সমিতি ও শহীদ সিরাজুল ইসলাম, বীর বিক্রম স্মৃতি সংসদ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

এসএস/এমএস

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন
পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।