মিনহাজ মান্নান ইমন

শেয়ারবাজারের সম্ভাবনা নিহিত সঠিক নেতৃত্বে, চ্যালেঞ্জ রাজনীতি

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:৩১ পিএম, ০৪ অক্টোবর ২০২৫
জাগো নিউজ আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে ডিএসই পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন

বাংলাদেশের শেয়ারবাজার আগামী ১০ বছরে ট্রিলিয়ন ডলারের ইকোনমি দিতে পারে মন্তব্য করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেছেন, শেয়ারবাজারের সম্ভাবনা নিহিত আছে সঠিক নেতৃত্বে। শেয়ারবাজারের সম্ভাবনা নিহিত সঠিক স্থিতিপত্রে, সম্ভাবনা রয়েছে কমিশন কাঠামোতে, সেখানে সৎ, যোগ্য রেলিভেন্ট ব্যক্তিদের দেওয়া। আর চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনীতি।

শনিবার (৪ অক্টোবর) জাগোনিউজ২৪.কম আয়োজিত ‘পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন তিনি। জাগো নিউজের সম্মেলন কক্ষে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

ডিএসইর এই পরিচালক বলেন, ‘আমাদের এখানে কমপক্ষে ৫০০ কোম্পানির রয়েছে যারা লিস্টেড হওয়ার উপযোগী। স্কয়ার, ভিয়ালা টেক্স, স্পারোসহ অনেক কোম্পানি রয়েছে যারা পুঁজিবাজারে আসবে না। এখানে কি সে কমিশনে গিয়ে এডি আর ডিডির কাছে গিয়ে হাত পা ধরে বসে থাকবে? ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট তারে সকাল-বিকেল লাথি-উসটা মারবে, সে যাবে? সাংবাদিকরা প্রতিদিন গুতাবে, এনবিআরের ভ্যাট- যাবে না সে (পুঁজিবাজারে)। সে ম্যানেজ করে চলতেছে। সুন্দর-সহজ গেটওয়ে রাখবেন, যাতে এখানে ঢুকলে কিছু প্রটেকশন সে পায়।’

তিনি বলেন, ‘পদে পদে ঘাটে ঘাটে আপনি যন্ত্রণা দিয়ে রেখেছেন, পদে পদে হয়রানি করার সব মেকানিজম করে রেখেছেন, পদে পদে বিনিয়োগকারীদের হয়রানি করার সব সিস্টেম করে রেখেছেন। আপনি দুষ্টের পালন আর শিষ্টের দমনের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। চ্যালেঞ্জগুলো যদি মোকাবিলা করতে না পারে এই শেয়ারবাজার কখনোই সামনে এগোবে না। এত অন্যায় নিয়ে শেয়ারবাজার কীভাবে চলবে?’

আরও পড়ুন
রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে পুঁজি লুট হয়েছে: মাহমুদ হোসেন
পুঁজিবাজারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নেগলেক্ট করে রাখা হয়েছে

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকায় স্টক এক্সচেঞ্জের চিন্তা করে লাভ নেই, আমাদের বদলাতে পারবে না। চেঞ্জ করতে পারবে কমিশন। কমিশন ঠিক থাকলে আমরা এমনিতেই ঠিক। আমাদের হাত-পা বাঁধা। নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নেতৃত্বেই পুঁজিবাজারের সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে চ্যালেঞ্জের পথ পেরিয়ে যেতে হবে।’

মিনহাজ মান্নান বলেন, ‘সংবিধান বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা রাখেনি। সাংবিধানিকভাবে বিনিয়োগকারীরা উপেক্ষিত।’

তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির মূল যে গতি সেটা থেকে আমাদের শেয়ারবাজার বিচ্ছিন্ন। খারাপ নিউজ যখন আসে, মন খারাপ নিয়ে শেয়ার বিক্রি করে দেয়। ভালো নিউজে বাজার বাড়ে না কেন? আমরা শেয়ারবাজারের সঙ্গে রিলেটেড না। পুঁজিবাজেরকে আমরা মূল স্রোতধারার সঙ্গে কখনো রিলেটেড করতে পারেনি। আপনি যদি উন্নত বিশ্বে যান, প্রকৃতপক্ষে শেয়ারবাজারের ব্যাপ্তি যদি বুঝতে চান, উন্নত বিশ্বে জিডিপির চেয়ে শেয়ারবাজারের মার্কেট বড় থাকতে পারে। সব জায়গায় নেই, তবে উন্নত বিশ্বে তাই? কাজেই জিডিপি থেকে মার্কেটকে বড় হতে হবে।’

আমাদের শেয়ারবাজার এত ছোট যে স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক হয়েও গল্প করার সময় আমাদের আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘প্রকৃত শেয়ারবাজার বাংলাদেশের জিডিপির কনটেক্সে যদি তুলনা করি, আমাদের শেয়ারবাজার থাকা উচিত এক বা দেড় ট্রিলিয়ন ডলার। তার মানে আমাদের দেশের পুঁজিবাজার প্রকৃত অর্থে কোনো পুঁজিবাজার নয়।’

কেন আমরা প্রকৃত অর্থে শেয়ারবাজার করতে পারিনি- প্রশ্ন রেখে ডিএসসি’র এই পরিচালক বলেন, ‘শেয়ারবাজারটাকে যদি অর্থনীতির মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতাম, যদি মনে করতাম ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে এটা অর্থনীতির টাকা জোগানোর একটা মাধ্যম, তাহলে এটার গুরুত্ব আমরা বুঝতাম। তাহলে আমরা যে কমিশন তৈরি করেছি সেখানে রেলিভেন্ট লোক দিতাম। যারা কমিশনার থাকবেন তারা শিক্ষক থাকুক বা মুদি দোকানের মালিক হয়ে আসুক বা মসজিদের ইমাম হোক, কোনো বিষয় না, সেই লোকটা এটি (পুঁজিবাজার) অর্থনীতির চালিকাশক্তি তা বোঝে কি না, শেয়ারবাজারে ইকোসিস্টেমটা সে বোঝে কি না, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।’

তিনি বলেন, ‘শিক্ষকরা তো দৌড় দিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আসেননি, তাদের আনা হয়েছে। আনার সময় পছন্দ করেছেন পচা আপেলটা, এটাতো শিক্ষকের দোষ না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন, শিক্ষক নামধারী গরু-ছাগলও আছে। আপনি কাকে পিক করবেন? আপনি যদি পরিচালক বানাতে গিয়ে সৎ ব্যক্তিকে না এনে খারাপ ব্যক্তি কে আনেন, আর দোষারোপ করেন, সেক্ষেত্রে তো ফলাফলটা পাবেন না।’

মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ‘নেতৃত্বের সঠিক জায়গাটা চিহ্নিত করতে হবে। আমরা কি সেই নেতৃত্বটা দিয়েছি? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবচেয়ে দুশ্চরিত্র ও দুর্নীতিবাজ লোকটাকে (এম খায়রুল হোসেন) নিয়ে এসেছেন। এমনকি তাকে তিনবার রাখা হলো। আইনের কোনো ধারাতে সেই সুযোগ নেই। সে কত বড় একজন কালাকার, সে এখন পালিয়েছে। এই লোক শেয়ারবাজারের নৈতিক জায়গাটাকে ধ্বংস করা শুরু করেছে। ইকো সিস্টেমটাকে ধ্বংস করেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেটুকু পানিতে ভেসে ছিল, তাকে আমি দুর্নীতির শিল্পী রুবায়েত বলি, এই লোকটা এসে নৌকাটাকে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে।’

ডিএসসির এই পরিচালক বলেন, ‘আমরা অনেকে এখন দোষারোপ করি টাস্কফোর্সকে, যারা কাজ করেছে, মন্দেরও ভালো দিক আছে। বর্তমান কমিশন যে জায়গায় এসে জিনিসগুলো পেয়েছে, বর্তমান কমিশনের চেয়ারম্যান সম্পর্কে অনেক অভিযোগ করেছি এখনো করি। উনি ভালো কাজ কী করেছেন, কিন্তু খারাপ কাজ একটিও করেননি।’

আরও পড়ুন
১৪ মাসে পোর্টফোলিও অর্ধেকে, আস্থা ফেরেনি বিনিয়োগকারীদের
পুঁজিবাজারে আস্থা ফেরাতে এজিএম, অডিট মান ও তথ্যের স্বচ্ছতা জরুরি

মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, ‘জরিমানা নিয়ে তার (বিএসইসির চেয়ারম্যান) অনেক সমালোচনা আছে। এখান থেকে একটা নতুন সূত্রপাত হতে পারে। এ কমিশন কিছু কাজ করে দিয়ে গেছে। রাজনৈতিক সরকার এলে এই কমিশন থাকবে কি না যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনোই কোনো ধীরস্থির, শুভ ও সুস্থির চিন্তার কোনো লোক রাখবে না।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক সিস্টেমটাই এমন, সে তার লোক আনবে। তাদের লোক তো তাদের মতো কথা বলবে। কাজেই এখান থেকে ভালো কিছু পাওয়া মুশকিল। কাজেই মূল সমস্যাটা হচ্ছে নেতৃত্বে, চিন্তা ও বাজার সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা নিয়ে। এখন বিনিয়োগকারীরা এসে দুঃখ পায়।’

আইপিওর মান নিশ্চিত না করে আইপিও দিলে এ বাজার কখনো ভালো হবে না মন্তব্য করে ডিএসইর এই পরিচালক বলেন, ‘আইপিও-র সিস্টেম ডেভেলপ না করে আইপিও দিলে কী লাভ! এখনকার সিস্টেমে বলা হয়েছে তিন বছর লাভ দেখিয়ে আসতে হবে। যে লোক তিন বছর লাভ করে সে কেন শেয়ারবাজারে আসবে? সে তো লাভ করতেছে, আমি লাভের টাকায় আপনাকে ভাগ দিয়ে দেবো, কি দরকারটা আমার?’

‘যে লোক শেয়ারবাজারে আসে সে আসলে ব্যালেন্স শিট বিক্রি করতে আসে না। সে সম্ভাবনা বিক্রি করতে আসে- ভাই, আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি, আমার সব স্বপ্নের অংশীদার আমি আপনাদের করতে চাই। আমার ব্যালেন্স শিটে লস আছে, সেটা বিনিয়োগকারী বুঝবে। সে শেয়ার কিনবে কি কিনবে না। অডিটর তো করেনি। সে দুই আর দুই যোগ করে একটা ব্যালেন্স শিট স্বাক্ষর করে। সে কিন্তু কোম্পানির সম্ভাবনা দেখতে পায় না। তার দেখার দায়িত্ব নয়। সে দেখবে দুই আর দুই ঠিক আছে কি না, ভাউচারটা ঠিক আছে কি না। কোম্পানির ভবিষ্যৎ দেখা তার দায়িত্ব নয়। তার দায়িত্ব নিরক্ষিত প্রতিবেদন সঠিকভাবে উপস্থাপন করা। দেখার দায়িত্ব ইস্যু ম্যানেজারের, দেখার দায়িত্ব এসেট ম্যানেজারের।’ যোগ করেন ইমন।

তিনি বলেন, ‘ভুয়া ব্যালেন্স শিট হোক, বিনিয়োগকারী দেখবে সে কিনবে কি কিনবে না। আপনি (বিএসইসি) তো সে রাস্তাও বন্ধ রাখছেন। ভুয়া ব্যালেন্স শিট দেন আবার বিনিয়োগকারীদের নানা সিস্টেম করে রেখেছেন, সেই ওই ফাঁদে পা দেয়।’

বর্তমান কমিশন দুর্নীতি থেকে দূরে থেকে কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘টাস্কফোর্স করেছেন, তাদের ১৭টি কার্যপরিধি দিয়েছেন। তাদের সক্ষমতা পাঁচটি, দিয়েছেন ১৭টি, এটা অসম্ভব। তারপরও তারা কিছু সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন।’

জরিমানা করার কারণে বাজারে একটি ভয় তৈরি হয়েছে মন্তব্য করে মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, সবাই মনে করছে পাপ করলে কিন্তু বাঁচা যাবে না। এই জরিমানা হয়তো কেউ দেবে না। আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জরিমানা ১০০ বছর পার হলেও দেবে না। কমিশন কিন্তু ভয় দেখিয়েছে এই অন্যায়গুলো করলে শাস্তি পাওয়া যেতে পারে। এই ভয়টা বাজারে ছিল না।’

তিনি বলেন, ‘বহু কষ্টে বর্তমান কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে কনসুলেটেড কাস্টমার অ্যাকাউন্টের (সিসিএ) সমস্যার সমাধান করেছি। এআইটির (আগাম কর) ক্ষেত্রে পাঁচ পয়সা কাটে, এটা পৃথিবীর কোথাও নেই। এটা আমাদের দেশের ক্যাপিটাল মার্কেটে আছে। অস্বচ্ছ, দুর্বল ও দুর্নীতিবাজ এনবিআর আমাদের এক কোটি টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা কাটে। বহু কষ্টে এটা ৩ হাজার টাকায় এনেছি। বিও অ্যাকাউন্ট রিনিউয়াল ফি নামে কোনো জিনিস পৃথিবীতে নেই। কেন ৫ টাকা রিনিউয়াল ফি দিতে হবে? সারা বছর ট্রেড করছি, ট্যাক্স দিচ্ছি- আবার ভিখারির মতো গেটে ঢুকতে দুই টাকা।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিছু জিনিস করাতে পেরেছি। ‌ চেয়ারম্যান আমাদের প্রতি আক্রমণাত্মক হননি। এগুলো একটি শুরু আর কি! সামনে নির্বাচন আছে।’

শেয়ারবাজারের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে ডিএসইর এই পরিচালক বলেন, ‘সম্ভাবনা পুরোটাই আছে। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে রাজনৈতিক সরকার। রাজনৈতিক সরকার যখন আসবে আমিও তো একটু আনন্দময় অবস্থায় আছি। আগের সরকারের সময় জেল খেটেছি, এই সরকার জেলে না ঢোকালেও মনে করবে এরা কাছাকাছি লোক। কিন্তু প্রথম মাইরটা আমাদেরকে দেবে।’

‘কারণ যারা এখানে (পুঁজিবাজার) ঢুকতে যাবে, তারা আমাদের প্রতিবন্ধক মনে করবে। এখানেও সেই একই লোকগুলো ভিন্ন বেশে কেউ টুপি পড়ে, কেউ মুজিব কোট খুলে এই সিস্টেমে ঢুকে যাবে।’ বলেন মিনহাজ মান্নান ইমন।

আরএমএম/ইএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।