সদরঘাটে বৃদ্ধের চুলা জ্বালানোর লড়াই

মাহমুদা আক্তার
সদরঘাটের ব্যস্ততম রাস্তার পাশ ঘেঁষে হাঁটছেন একজন বৃদ্ধ। পরনে পুরনো লুঙ্গি, রংচটা টি-শার্ট, কাঁধে বিশাল এক ময়লার বস্তা। তাঁর পায়ের চপ্পল যেন মাটি আর ধুলার সঙ্গে মিশে গেছে। মাথার চুলে বয়সের চিহ্ন - শুভ্র সাদা। তবু থেমে নেই হাঁটা, থেমে নেই জীবনের সংগ্রাম।
চারদিকে বিশাল বিশাল জাহাজের ভিড়, পানির গায়ে ভেসে বেড়ানো আবর্জনা আর নোংরা ঘাট। কোথাও ইঞ্জিনের শব্দ, কোথাও শ্রমিকদের চিৎকার। এর মধ্যেই তিনি চুপচাপ এগিয়ে চলেছেন সবার অগোচরে, অবহেলায়।
এই মানুষটি পেশায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী নন, তিনি কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন না। জীবিকার টানে প্রতিদিন নদীর পাড়, জাহাজঘাট আর শহরের কোণায় কোণায় পড়ে থাকা আবর্জনার মধ্যে খুঁজে ফেরেন টুকরো টুকরো প্লাস্টিক, লোহা, বোতল। এসব জমিয়ে দিনশেষে বিক্রি করেন। যা পান, তা দিয়েই কোনো রকমে চালান ক্ষুধার্ত সন্ধ্যা।
আজ মে দিবস, শ্রমিকদের অধিকার আর সম্মানের প্রতীক। বড় বড় শহরে, নামীদামী অফিসে, সভা-সমাবেশে আলোচনা হবে। বলা হবে শ্রমের মহিমার কথা। ব্যানারে ঝলমল করবে 'শ্রমিকের সম্মান চাই', 'সমান মজুরি চাই' ইত্যাদি স্লোগান। কিন্তু এই মানুষগুলো, যারা বাস্তব জীবনের যোদ্ধা, তাদের নাম উচ্চারিত হবে কি? কে শুনবে এই চুপচাপ বয়ে চলা ঘামের গল্প?
সদরঘাটের পচা গন্ধমাখা বাতাসে, খসে পড়া রঙের জাহাজের ছায়ায়, এই মানুষটি প্রতিদিন নিজের শ্রম দিয়ে শহরটাকে একটু হলেও পরিচ্ছন্ন রাখছেন। অথচ তার কোনো সামাজিক নিরাপত্তা নেই, নেই স্থায়ী আয় বা চিকিৎসার নিশ্চয়তা। বৃদ্ধ বয়সেও তার ঘাম ঝরে, কারণ ঘাম না ঝরালে চুলায় আগুন জ্বলে না।
তার হাতে নেই কোনো হাতঘড়ি, তবু সময়ের হিসাব তার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। কখন দিনের আলো কমবে, কখন নদীর পানি ফুলে উঠবে সব তার বুকের ঘড়িতে টিকটিক করে বেজে ওঠে। মুখের গভীর রেখায় জমে থাকা ক্লান্তি বলে দেয়, তার জীবনের প্রতিটি দিনই যেন একটি যুদ্ধ।
মে দিবসে আমরা যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে শ্রমের গান গাইবো, তখন মনে রাখা দরকার, এই নীরব যোদ্ধারাও শ্রমের কাব্যের অমর চরিত্র। যাদের জন্য সভ্যতা এগোয়, শহর জাগে, মানবতা দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ তাদের জন্য ফুল নিয়ে আসে না। কেউ 'ধন্যবাদ' বলে না। তবু তারা প্রতিদিন ঘাম ঝরায়, জীবন বুনে চলে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে।
আজকের এই মে দিবসে তাই প্রতিজ্ঞা করা হোক শুধু ব্যানার টাঙিয়ে নয়, শুধু বক্তৃতা দিয়ে নয়; বাস্তবের এই মেহনতি মানুষগুলোর জীবনেও আলো ফেলার। তাদের জন্য ন্যায্য সম্মান, ন্যায্য মজুরি আর সম্মানজনক জীবন নিশ্চিত করার। কারণ, শহরের চকমকে আলো আর ভবিষ্যতের উজ্জ্বল স্বপ্ন, তাদের ঘামে ভেজা পায়ের ছাপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
এএমপি/এএসএম