‘দিবস কী জানি না, মাথায় টুকরি উঠলে আসে টাকা, চলে পেট’

অভিজিত রায় (কৌশিক)
অভিজিত রায় (কৌশিক) অভিজিত রায় (কৌশিক) , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৩৯ এএম, ০১ মে ২০২৫
কারওয়ান বাজারে পণ্য বহনের অপেক্ষায় শ্রমিকরা। ছবি: জাগো নিউজ

বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের প্রতীকী দিন মে দিবস। আন্তর্জাতিকভাবে এই দিনটি শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়। তবে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের এই দিনটি সম্পর্কে জানেন না জীবন-সংগ্রামে প্রতিনিয়ত লড়ে যাওয়া সোহরাব খান, নীল চাঁদ, আব্দুল আলিম, মো. দুলাল কিংবা মন্নানের মতো শ্রমিকরা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কুলির কাজ করেন তারা। বাজার করতে আসা ক্রেতা-ভোক্তাদের পণ্য মাথার টুকরিতে বহন করেন। অন্যের বাসার খাবার গন্তব্যে পৌঁছে দিলেই মেলে সামান্য কিছু টাকা। আর সেই টাকায় জোগাড় হয় পরিবারের খাবার। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’ অবস্থার এই শ্রমিকরা জানেন না শ্রমিক দিবস কী।

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় বাড়ি সোহরাব খানের। বাড়িতে স্ত্রী, দুই মেয়ে, ছেলে ও ছেলের বৌ আছে। ছেলে ও তার স্ত্রীর আলাদা সংসার। অনেক কষ্টে অর্থ জোগাড় করে বড় মেয়ের বিয়ে দিতে পারলেও অর্থাভাবে আরেক মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না।

আয় কম হওয়ায় বিয়ে দিতে পারছেন না বলে জানান সোহরাব খান। দিনে ৩০০-৪০০ টাকা রোজগার নিয়ে কোনো রকম নিজে টিকে থেকে পরিবারের হাল ধরেছেন। সেই সঙ্গে বড় মেয়ে ও জামাইয়ের সহযোগিতায় সংসার কোনো মতে চলে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

‘দিবস কী জানি না, মাথায় টুকরি উঠলে আসে টাকা, চলে পেট’

সোহরাব খান বলেন, ‘৪৩ বছর ধরে কাজ করছি। আগে দিনে ১৫০ টাকা ইনকাম করলেও তা দিয়ে ভালোভাবে সংসার চলে যেতো। এখন সারা দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ইনকাম করি। তা দিয়েও সংসার চলে না। তাছাড়া এখন ১৫০ টাকা ইনকাম করতেই অনেক কষ্ট হয়ে যায়।’

‘আগে তেজগাঁও রেলস্টেশন কোয়াটারে থাকতাম, পরে ২০-২২ বছর ধরে আলুর আড়তেই থাকি। থাকার জায়গাও লাগে না, রাত হলেও কাম করা লাগে। দিন হলেও কাম করা লাগে। দিনরাত খাটি, যা-ই ইনকাম হয়। এর মধ্যে ঘুম পাড়ার কোনো টাইম নাই। এই দিয়ে নিজে চলি, সংসার চালাই।’ বলছিলেন সোহরাব খান।

সিরাজগঞ্জে বাড়ি নীল চাঁদ হোসেনের। দীর্ঘদিন ঢাকার কারওয়ান বাজারে অন্যের পণ্য মাথায় টুকরি বহন করে সংসার চালান তিনি। নিজে একজন শ্রমিক হয়েও শ্রমিক দিবসের কথাই জানেন না নীল চাঁদ।

তিনি বলেন, ‘শুধু আমার কর্মের ওপর ভিত্তি করে সংসার চলে না। অনেক কৌশলে সংসার চালাতে হয়। ধারদেনা-ঋণ করতে হয়। প্রতিদিনের ইনকাম দিয়ে প্রতিদিন চলতে হয়। অসুস্থ হলে কাজ ফেলে বাড়ি চলে গেলে এলাকার মানুষের কাছে হাত পেতে চলতে হয়। হাওলাত নিয়ে ইনকাম করে দেনা শোধ করে চলতে হয়। খুব কষ্টে চলতে হয়। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আমাদের কষ্ট দেখার মতো কেউ নেই।’

‘দিবস কী জানি না, মাথায় টুকরি উঠলে আসে টাকা, চলে পেট’

একই কষ্টের কথা তুলে ধরে আব্দুল আলিম বলেন, ‘মে দিবস কী জানি না। কাম করে খেতে হয়। এখন কাম একদমই কম। নেই বললেই চলে। অসুস্থ হলে দেশে চলে যাই, তখন ইনকাম থাকে না। তিন বেলার জায়গায় দুই বেলা খেতে হয়।’

মে দিবসটা কী জানতে চাইলে মো. দুলাল বলেন, ‘দিবস-টিবস কী জানি না।’

দিবসটি শ্রমিকদের ছুটির দিন জানালে দুলাল বলেন, ‘আমাগের আর ছুটি। কাজ না করলে তো আর বেতন নেই। আমি ইনকাম করে বাড়িতে পাঠালে পরিবার চলে। পরিবারের খরচ চালাতে একেক জনকে ১২, ১৪, ১৬ ঘণ্টা ডিউটি করতে হচ্ছে। একদিন যদি কাজ না করে বসে থাকি, কেউ ১০টা টাকাও দেবে না। বসে থাকলে চলবে না, পেটে খাবার বন্ধ হয়ে যাবে।’

দিন দিন উপার্জন কমছে বলে একই ধরনের অভিযোগ সোহরাব খান, নীল চাঁদ, আব্দুল আলিম, মো. দুলাল কিংবা মন্নানের মতো এই কাজে নিয়োজিত অন্য শ্রমিকদেরও। এই রোজগার কমার পেছনে বাজার করতে আসা সাধারণ মানুষ বর্তমানে বাজার শেষে অটোরিকশা, সিএনজি বা নিজস্ব পরিবহন ব্যবহার করছেন বলে মনে করছেন তারা। ফলে পরিবারের খরচের হিসাব মেলাতে শ্রমিক দিবসের ছুটির হিসাব বোঝেন না তারা। বরং নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে খেয়ে পরে বাঁচতে রাত দিন কাজ করতে হয় তাদের।

বিশ্বজুড়ে ১ মে শ্রম দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। এই দিবস পালনের পেছনে রয়েছে ঊনবিংশ শতাব্দী ও তার আগের শ্রমিকদের বঞ্চনার করুণ ইতিহাস।

‘দিবস কী জানি না, মাথায় টুকরি উঠলে আসে টাকা, চলে পেট’

এই সংগ্রাম ও ইতিহাসের শুরুটা ঘটে যুক্তরাষ্ট্রে। ১৮৮৬ সালের এই দিনে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ক্রমেই জড়ো হতে থাকেন শ্রমিকরা। তাদের দাবি ছিল, ন্যায্য মজুরি এবং কাজের জন্য নির্ধারিত সময়। যুগের পর যুগ তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বঞ্চনার প্রতিবাদ ছিল এই আন্দোলন। একেকজন শ্রমিককে সেই সময় বাধ্যতামূলক খাটানো হতো ১৫ থেকে ১৬ ঘণ্টা, বিনিময়ে পারিশ্রমিক ছিল খুবই সামান্য।

শ্রমিকদের সেই আন্দোলনে ঘটে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। হঠাৎ শ্রমিকদের ঘিরে থাকা ভিড় থেকে কেউ একজন পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করেন। ঘটনার আকস্মিকতায় সেদিন বিহ্বল ছিলেন আন্দোলনে অংশ নেওয়া প্রায় সবাই। এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। আর ঝরে পড়ে ১০ থেকে ১২টি তাজা প্রাণ। পুলিশসহ ওই ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা ছিল আরও অনেক।

বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের বঞ্চনার পাশাপাশি কণ্ঠরোধের চেষ্টায় নির্মম এক ইতিহাস তৈরি হয় সেদিন। ন্যায্য দাবির জন্য আন্দোলনে প্রাণ হারানো সেই মানুষগুলোর স্মরণে প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রসহ সারা বিশ্বে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।

কেআর/এমএমএআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।