ঝুড়ির হিসাবেই চলে বালু শ্রমিকদের জীবন

সকালের প্রথম আলো ফোটার আগেই তুরাগ নদীর তীরে শুরু হয় জীবনের এক কঠিন সংগ্রাম। গাবতলীর এই নদীতটে সারি সারি ট্রলার ভিড়ে থাকে। আর সেই ট্রলারগুলো থেকে ঝুড়ি ভরে বালু নামায় শত শত নারী, পুরুষ। তাদের হাতে থাকে শক্ত বাঁশের ঝুড়ি, কাঁধে ফাটা রশির দাগ। ঘাম ঝরানো এই কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই, নেই কোনো ছুটি, নেই কোনো নিশ্চিন্ত বিশ্রাম।
এক ঝুড়ি, দুই ঝুড়ি, তিন ঝুড়ি-এভাবে সারাদিন চলে ঝুড়ির হিসাব। কয় ঝুড়ি বালু নামালো, তার হিসাব রাখার জন্য তারা ব্যবহার করে কয়েন, লুডুর গুটি কিংবা ইটের টুকরো। পকেটে অথবা মাটির ওপর রাখা থাকে সেই গুটিগুলো। দিনের শেষে সেই গুটির গনণাতেই মেলে তাদের পরিশ্রমের মজুরি। তবে সেই মজুরি কতটুকু? যে ঘাম নদীতে মিশে যায়, যে পিঠ রোদে ঝলসে যায়, তার দাম কি মেলে?
মে দিবস শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন। কিন্তু তুরাগ পাড়ের এই মানুষগুলো জানেই না মে দিবস কাকে বলে। তাদের কাছে প্রতিটি দিন একই রকম কঠিন, নির্দয়। কেউ কখনো তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলেনি, কখনো কেউ শোনেনি তাদের নীরব আর্তনাদ। পায়ের নিচে নরম বালু হলেও জীবনের বাস্তবতা তাদের জন্য যেন পাথরের মতো কঠিন।
নদীর ধারে কথা হয় লাইলি বেগমের সঙ্গে। বয়স পঁয়ত্রিশের কোঠায়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ট্রলার থেকে বালু নামান তিনি। পাশে ছোট্ট ছেলেটা বসে আছে, মায়ের কাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষায়। লাইলির কণ্ঠে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, তবুও এক ধরনের মমতার ঝিলিক দেখা যায় চোখে। তিনি বলেন, ‘ছেলেপুলের মুখে ভাত দিতে হয়। ঝুড়ি বাইরাই জীবন চলে। মজুরি পাই, কিন্তু কতটুকু? ঝড়, রোদ, বৃষ্টি কিছু থামাইতে পারে না আমাদের।’
লাইলির মতো হাজারো শ্রমিক প্রতিদিন এভাবে বেঁচে থাকেন। তাদের নেই কোনো স্বাস্থ্যসেবা, নেই সুরক্ষার ব্যবস্থা। পায়ে কাঁটা ফুটলে কিংবা রোদে পিঠের চামড়া ঝলসে গেলে নিজে নিজেই সামলে নিতে হয়। একদিন অসুস্থ হয়ে কাজ বন্ধ মানেই সেই দিন থাকতে হয় উপোস। তারপরও তারা কাজ করে চলেন, জীবনের দায়ে।
তুরাগের এই শ্রমিকদের জীবন যেন এক দীর্ঘ অবহেলার প্রতিচ্ছবি। শ্রমের মূল্য কতটা অমূল্য, তা তারা জানেন না; তাদের কেউ জানায়ওনি। অথচ তারাই দেশের উন্নয়নের নীরব কারিগর। তাদের ঘামেই তৈরি হয় শহরের দালান, তাদের পরিশ্রমেই ভরাট হয় নতুন আশার ভূমি।
মে দিবসের আদর্শ ছিল শ্রমিকের সম্মান, ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশের জন্য সংগ্রাম। অথচ তুরাগের পাড়ে আজও সেই সংগ্রামের প্রতিধ্বনি পৌঁছায়নি। এখানে মে দিবসের লাল পতাকা উড়ে না, এখানে শুধু উড়ে ফাটা পোশাকের কিনারা। এখানে চিৎকার করে ওঠে নদীর বাতাস, এখানে ঝুড়ি ঝুড়ি বালুর সঙ্গে ভেসে যায় নামহীন শ্রমিকদের স্বপ্ন।
যখন শহরে মে দিবস উপলক্ষে সভা, সেমিনার আর শোভাযাত্রা হয়, তখন তুরাগের শ্রমিকেরা হয়তো তখনো নদীর বুকে নেমে বালু তুলছেন। কোনো ব্যানার তাদের মাথার ওপর ছাতা হয়ে দাঁড়ায় না, কোনো স্লোগান তাদের কানে পৌঁছায় না। তাদের জন্য মে দিবস শুধুই আরেকটা কাজের দিন,আরেকটা জীবনের দিন।
তুরাগের এই শ্রমিকরা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কেবল দিবসের আয়োজন যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন শ্রমিকের প্রতি প্রকৃত সম্মান, তাদের শ্রমের যথাযথ মূল্য নিশ্চিত করা। তবেই সত্যিকারের মে দিবসের স্বপ্ন পূরণ হবে। নদীর এই নিরব কান্না থামবে তখনই, যখন তাদের ঘাম ঝরার সঙ্গী হবে মর্যাদা আর ন্যায্য অধিকার।
কেএসকে/এএসএম