শ্রমিক খুশি বেওয়া

কাম করে ভাত খাই, দিবস দিয়ে কী করমো

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি গাইবান্ধা
প্রকাশিত: ০৪:১৭ পিএম, ০১ মে ২০২৫
ইট ভাঙার কাজ করছেন খুশি বেওয়া/ছবি-জাগো নিউজ

৫০ বছর বয়সী খুশি বেওয়া। স্বামী মারা গেছেন অনেক আগেই। তিন সদস্যের সংসার। সংসার চালাতে ২০ বছর ধরে ইট ভাঙার শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। কাজ করলে দিনে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা আয় করেন। তার আয়ের টাকা দিয়েই চলে সংসার চলে। মে দিবসেও দেখা গেলো কাজ করছেন ইট ভাঙার।

বৃহস্পতিবার (১ মে) দুপুরে গাইবান্ধা শহরের গোডাউন এলাকায় ইট ভাঙার কাজ করছিলেন তিনি। মে দিবস বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান।

খুশি বেওয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘হামরা দিবস দিয়ে কী করমো (আমরা দিবস দিয়ে কী করবো)? কাম করলে ভাত জোটে, না করলে উপোস থাকতে হয়।’

শামসুল (৫৫) নামের আরেক শ্রমিক বলেন, ‘গরিব মানুষের আবার শ্রমিক দিবস! একদিন কাম না করলে পেটে ভাত যায় না। শুধু দিবসই পালন হয়, আমাদের ন্যায্য মজুরি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেই।’

কাম করে ভাত খাই, দিবস দিয়ে কী করমো

পেটের দায়ে রিকশা চালায় কিশোর খায়রুল ইসলাম (১৫)। বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজলার অদূরে প্রধানের বাজার এলাকার হাজারি গ্রামে। বাবা আয়নাল হক একজন কৃষিশ্রমিক। ছোট দুই ভাই ও এক বোনকে নিয়ে পাঁচ সদস্যের সংসার। বাবার সামান্য আয়ে সংসার চলে না। সংসারের বড় ছেলে সে। পরিবারে সচ্ছলতা আনতে তাই রিকশা চালায় খায়রুল ইসলাম। জেলা শহরে রিকশা চালিয়ে দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করে সে। মাসের ৩০ দিনই রিকশা চালাতে হয় তাকে। তাই পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি তার। স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে খায়রু ইসলাম।

খায়রুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলে, ‘এবছর এসএসসি পরীক্ষা দিতাম। কিন্তু টাকার অভাবে বাকি লেখাপড়া করতে পারিনি। বাড়িতে ছোট ছোট ভাই বোন আছে। বাবার আয় দিয়ে সংসার চলে না। পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে রিকশা চালাতে হচ্ছে। আমি পরিবারের বড় ছেলে। দায়িত্ব আমার বেশি। ছোট ভাইয়েরা তো আর কাজ করতে পারে না।’

একই উপজেলার ফারাজি পাড়ার রিফাদ মিয়া (১৪)। চার বছর ধরে ঝালাইয়ের দোকানে কাজ করে। গ্রামের স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। পরিবারের অভাবে পরে আর স্কুলে ভর্তি হয়নি। এখন ঝালাইসহ রডের যাবতীয় কাজ করে রিফাত। সে জানায়, সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করে।

কাম করে ভাত খাই, দিবস দিয়ে কী করমো

খায়রুল ও রিফাদের মতো গাইবান্ধায় শিশুশ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। তবে গাইবান্ধা জেলায় কী পরিমাণ শিশুশ্রমিক রয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যান জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে নেই। কিন্তু বেসরকারি উনয়ন সংস্থাগুলোর হিসেবে, জেলায় প্রায় ১২ হাজার শিশুশ্রমিক রয়েছে। যারা বিভিন্ন ঝুকিপূর্ণ কাজ করে।

শহরের সার্কুলার রোডে আসাদুজ্জামান মার্কেটে এলাকায় ফুলের দোকানে কাজ করছে নিরব মিয়া (১৫)। তার বাড়ি সদর উপজলার সরকারপাড়া এলাকায়। নিরব জানায়, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে সে। পরে টাকার অভাবে আর লেখাপড়া অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। প্রায় পাঁচ বছর আগে চায়ের দোকানে কাজ করেছিল। এখন ফুলের দোকানে কাজ করেছে। দৈনিক মজুরি পায় ৩০০ টাকা। এ দিয়েই চলে তার সংসার।

শহরের গোরস্তান মোড় এলাকায় মোটরসাইকেল গ্যারেজে কাজ করছিল কিশোর কবির হাসান (১৩)। তার বাড়ি শহরের পুলিশ লাইনস এলাকায়। কবির জাগো নিউজকে বলে, ‘এক বছর লেখাপড়া করেছি। পরে আর স্কুলে যাইনি। পাঁচ বছর ধরে গ্যারেজে কাজ করছি। মোটরসাইকেল মেরামতের কাজ শিখেছি। কাজ করে দৈনিক ২০০ টাকা মজুরি পাই।’

কাম করে ভাত খাই, দিবস দিয়ে কী করমো

একই মার্কেটের ঝালাইয়ের দোকানে কাজ করছে রাজিব মিয়া (১৬)। বাড়ি পুটিমারি এলাকায়। তার কাজটা খুবই ঝুঁকিপুর্ণ। মেশিন দিয়ে ঝালাইয়ের স্থানে পরিষ্কার করতে হয় তাকে। সেজন্য অন্য শ্রমিকের তুলনায় মজুরিও সে বেশি পায়।

জেলায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করা মো. মেহেদী জাগো নিউজকে বলেন, শিশুশ্রম বন্ধে জেলায় কোনা প্রতিষ্ঠানেরই তেমন কোনা উদ্যোগ নেই। পরিবারের আর্থিন অনটনের কারণে অল্প বয়সী এসব শিশু অমানবিক পরিশ্রম করছে। এতে জেলায় ক্রমেই শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব শিশু বিভিন্ন গ্যারেজ, লেদ ও ঝালাইয়ের দোকানে কাজ করছে। ফলে শিক্ষার আলো থেকে তারা দূরে সরে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

গাইবান্ধা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (উন্নয়ন ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা) এ কে এম হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, দেশে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। শিশুশ্রম কমানোর জন্য আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেবো।

শ্রমিক নেতা কাজী আমিনুল ইসলাম ফকু বলেন, সবকিছুর দাম বেশি। তবে শ্রমিকদের মজুরি সে ‍তুলনায় বাড়ে না। শ্রমিকদের শ্রমের ন্যায্য মূল্যের দাবি জানান তিনি।

এ এইচ শামীম/এসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।