দীপ্তিময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ফিচার ডেস্ক
ফিচার ডেস্ক ফিচার ডেস্ক
প্রকাশিত: ১২:৫৩ পিএম, ১২ জানুয়ারি ২০২২

ড. আহমেদ সুমন
আজ ১২ জানুয়ারি ২০২২, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আশা করা হয়েছিল যে, মহামারি করোনার বিরুদ্ধে মানুষ জয়ী হবে। করোনায় সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার অতি সীমিত থাকবে এবং এ বছর কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব বর্ণাঢ্য আয়েজনের মধ্যদিয়ে পালন করবেন।

তবে লক্ষণীয় যে, করোনায় সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার উর্ধ্বমুখী। ফলে ১২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনটিতে অল্প পরিসরে অনলাইন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আপাতত কর্মসূচি সীমিত থাকছে। করোনার প্রকোপ আবার কমে গেলে বৃহৎ পরিসরে প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্ত্রী পালনের ইচ্ছে আছে। বর্তমান নিবন্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমান বয়সী এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস খানিকটা হলেও তুলে ধরা আবশ্যক বলে মনে করছি।

আমরা জানি, ইংরেজ শাসনামলেই পূর্ববাংলায় একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের দাবি ক্রমশঃ জোরালো হয়ে উঠে। ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত বাতিল ঘোষিত হওয়ার পরে অখণ্ড ভারতের প্রধান প্রশাসক লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফরে আসেন। এ সময় নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহসহ আরও অনেকে পূর্ববাংলার মানুষের জন্য একটা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের দাবি জানান।

ইংরেজ সরকার উপর্যুপরি দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। তখন পূর্ববাংলার নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। ১৯২১ সাল থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, কৃষি, প্রকৌশল ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলেও পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিল না।

এজন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকার কাছাকাছি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার সালনায়। কিন্তু নানা কারণে শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালে ঢাকা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে সাভার এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন স্থান নির্বাচন করা হয়।

সাভারের ওপর দিয়ে চলে গেছে এশিয়ান হাইওয়ে। এই মহাসড়কের পশ্চিমপাশে নির্ধারণ করা হয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার স্থান। এর পাশে বর্তমানে রয়েছে ডেইরি ফার্ম, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সাভার সেনানিবাস ও জাতীয় স্মৃতিসৌধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প প্রধান হিসেবে ড. সুরত আলী খানকে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭০ সালের ২০ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান সরকার এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে এ নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখে ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’।

১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন বিশিষ্ট রসায়নবিদ অধ্যাপক ড. মফিজউদ্দিন আহমদ। ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রিয়ার এ্যাডমিরাল এস এম আহসান আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’-এর উদ্বোধন করেন। তবে এর আগেই ৪ জানুয়ারি অর্থনীতি, ভূগোল, গণিত ও পরিসংখ্যান বিভাগে ক্লাশ শুরু হয়।

প্রথম ব্যাচে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১৫০ জন। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট পাশ করা হয়। এই এ্যাক্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’। ৬৯৭.৫৬ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ৫টি অনুষদের অধীনে ৩৩টি বিভাগ চালু আছে। এছাড়া ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি (আইআইটি), ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ-জেইউ), বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং ও ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। আবাসিক হল ১৬টি। ছাত্রছাত্রী সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে যারা উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তারা হলেন: অধ্যাপক ড. মফিজউদ্দীন আহমদ (২৪-০৯-৭০ থেকে ০১-০২-৭২), অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান (০২-০২-৭২ থেকে ০১-০২-৭৫), ড. মুহম্মদ এনামুল হক (০২-০২-৭৫ থেকে ৩০-০৪-৭৬), অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী (০১-০৫-৭৬ থেকে ৩০-০৪-৮৪), অধ্যাপক ড. আ ফ ম কামালউদ্দিন (০১-০৫-৮৪ থেকে ০৬-০১-৮৮), অধ্যাপক মোহাম্মদ নোমান (০৭-০১-১৯৮৮ থেকে ০৯-০৩-১৯৮৮), অধ্যাপক ড. কাজী সালেহ আহমেদ (১০-০৩-৮৮ থেকে ০১-০৮-৯৩), অধ্যাপক আবুল হোসেন (০৩-০৮-৯৩ থেকে ১৮-০৬-৯৪)।

অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম চৌধুরী (১৮-০৬-৯৪ থেকে ১৮-০৭-৯৮), অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিন আহমেদ (১৮-০৭-৯৮ থেকে ০৯-১১-৯৯), অধ্যাপক আবদুল বায়েস (১০-১১-৯৯ থেকে ১২-১১-০১), অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন আহমদ (১২-১১-০১ থেকে ২০-০৩-০৪), অধ্যাপক ড. খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান (২০-০৩-০৪ থেকে ২০-০৩-০৮) ও অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান (২৫-০৩-০৮ থেকে ২৪-০২-০৯), অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির (২৪-০২-২০০৯ হতে ২০-০৫-২০১২), অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন (২০-০৫-২০১২ হতে ২২-০১-২০১৪), অধ্যাপক ড. এম এ মতিন (২৩-০১-২০১৪ হতে ০২-০৩-২০১৪) এবং অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম (০২-০৩-২০১৪ হতে চলমান)।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ৫টি সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রথম সমাবর্তনে ৪ হাজার ৪৮৪ জন গ্র্যাজুয়েটকে, ২০০১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সমাবর্তনে ৫ হাজার ১২ জন গ্র্যাজুয়েটকে, ২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তৃতীয় সমাবর্তনে ৪ হাজার ৩৮৩ জন গ্র্যাজুয়েটকে, ২০১০ সালের ৩০ জানুয়ারি চতুর্থ সমাবর্তনে ৩ হাজার ৮৭৪ জন গ্র্যাজুয়েটকে এবং ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সমাবর্তনে ৮ হাজার ৬০০ জন গ্র্যাজুয়েটকে সনদপত্র প্রদান করা হয়।

এই সময়ে ২৭৭ জন গবেষককে এম.ফিল এবং ৫৪৫ জনকে পিএইচ.ডি সনদ প্রদান করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে শিক্ষক সংখ্যা ৭২১ জন, অফিসার ৩৪২ জন, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ৭৯২ জন এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সংখ্যা ৫৯৪ জন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ দীর্ঘ যাত্রায় অনেক মাইল ফলক অর্জিত হয়েছে। দীপ্তিময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তবুদ্ধি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার ঋদ্ধতায় দেশ-জাতির সমৃদ্ধ হওয়ার অনেক নজির আছে। বর্তমান একটি মাত্র নিবন্ধে স্বল্পপরিসরে সেসব দিক তুলে ধরা সম্ভব নয়। এ কারণে বর্তমান নিবন্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার দিকটি অল্পবিস্তর তুলে ধরার একটা প্রয়াস নেওয়া যেতে পারে।

বলা প্রয়োজন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পাইওনিয়ার। ২০০১ সালের ১২ জানুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল বায়েস বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালনের মধ্যদিয়ে এর প্রচলন করেন। এর আগে ১৯৯৬ সালে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম চৌধুরী বর্ণিল আয়োজনের মধ্যদিয়ে ২৫ বছর পূর্তির রজতজয়ন্তী পালন করেন।

একটি উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রার প্রাক্কালে দেশের খ্যাতনামা শিক্ষকদের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষা ও গবেষণায় দেশে-বিদেশে প্রেস্টিজিয়াস এ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন।

সরকারের উপদেষ্টা, মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রেখেছেন। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদক লাভ করেন। ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বাংলা একাডেমি পুরস্কার, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল কাইউম বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন পুরস্কার লাভ করেন।

বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক মো: নূরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন পুরস্কার লাভ করেন। ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর এমিরিটাস ইতিহাসবিদ ড. আজিজুর রহমান মলিক এক সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন।

রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ সফিউল্লাহ ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স এবং থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স স্বর্ণপদক অর্জন করেন। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইলিয়াস মোল্লা ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এইচ পি রায় স্বর্ণপদক লাভ করেন। অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এ্যাওয়ার্ড, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স স্বর্ণপদক, ২০০৭ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স- ড. এম ও গণি স্বর্ণপদক লাভ করেন।

পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সলিমউল্লাহ ১৯৮১ সালে এইচ পি রায় স্বর্ণপদক, ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স ও টি ডব্লিউ এস পুরস্কার, ১৯৯৪ সালে ইরানের আল খারাজমী পুরস্কার, ২০০২ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স সিনিয়র গ্রুপ পুরস্কার এবং ২০০৩ সালে ISESCO SCIENCE এ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুনিরুজ্জামান ১৯৮৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন পুরস্কার লাভ করেন।

অধ্যাপক ড. এ এ মামুন ২০০৯ সালে The Bessel Research Prize এবং ২০০৬ সালে Third World Academy of Science (TWAS) ও ২০০০ সালে Young Physicist Medal and Certificate লাভ করেন। ড. মামুন ২০০৪ সালে Bangladesh Academy of Science Gold Medal (Junior Group) এবং ১৯৯২ সালে TWAS Best Young Scientist Prize লাভ করেন।

প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসেন এবং মাইক্রোবায়োলজী বিভাগের ড. আলী আজম তালুকদার ২০০৬ সালে Bangladesh Academy of Science Gold Medal (Junior Group) লাভ করেন। অধ্যাপক ড. মো. শাহাদাত হোসেন ২০০৬ সালে TWAS Best Young Scientist Prize লাভ করেন।

নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক মো: আকতার মাহমুদ ২০০৯ সালে U.S.Department of State Award লাভ করেছেন। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান নরসিংদীর উয়ারি বটেশ্বরে ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে প্রাচীন সভ্যতা আবিস্কার করে এ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশকে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন আহমদ শিক্ষা ও গবেষণায় ২০০৬ সালে, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম আল দীন ২০০৭ সালে একুশে পদক লাভ করেছেন। এ ছাড়াও অধ্যাপক ড. সেলিম আল দীন ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৪ ও ১৯৯৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ২০০০ সালে কলকাতা নান্দীকার পুরস্কার লাভ করেন।

২০০৪ সালে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বেগম রোকেয়া পদক এবং ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন এ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। ইরানের তেহরানে ২০০৭ সালের জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে সপ্তম স্থান অধিকার করে।

সাম্প্রতিককালে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এ মামুন, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. তপন কুমার সাহা, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তফা ফিরোজ, অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. নজরুল ইসলাম প্রান্তিক, অধ্যাপক ড. মনজুর হাসান ইউজিসি এ্যাওয়ার্ডসহ দেশ-বিদেশের সম্মানজনক এ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন।

এ নিবন্ধের সূচনাতে মহামারি করোনার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এ কথা কারও অজানা নয় যে, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি আমাদের সবকিছুকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এ মহামারিতে পৃথিবীর প্রায় সবক্ষেত্রেই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। এরমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্র অন্যতম। আবার এটাও সত্য যে, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন অভিজ্ঞতা এবং সম্ভাবনার দ্বারও উন্মুক্ত হয়।

সারা জীবন যে শিক্ষকগণ প্রচলিত টিচিং-লার্নিংয়ে অভ্যস্ত, তারা সবাই অনলাইন বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে ক্লাস নেওয়া, ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন করার পদ্ধতি রপ্ত করেছেন। করোনায় শিক্ষাক্ষতি পুষিয়ে নিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্মত একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে পাইওনিয়ার হয়েছে।

উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার কথা ভেবে কোনো রকম ঝুঁকি ছাড়াই অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন ক্লাস এবং পরীক্ষা নেয়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গ্রহণ করেছে। উপাচার্য মনে করেন, এক সময়ে মানুষ করোনার বিরুদ্ধে জয়ী হবে। সেই সময়েও আজকে অনলাইনের যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, তার ব্যবহার অব্যাহত থাকবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখিমেলা এবং প্রজাপতি মেলা দেশজুড়ে সমাদৃত। বাংলাদেশে এ দুুটি মেলা এখানেই প্রথম চালু হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের আয়োজনে বিপন্নপ্রায় বণ্যপ্রাণি সংরক্ষণ কেন্দ্র এবং প্রজাপতি পার্ক স্থাপন করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান দেশ-বিদেশে প্রশংসা লাভ করেছে।

বিপন্নপ্রায় বণ্যপ্রাণি সংরক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ পরিবেশের প্রতি অবদান স্বরূপ জাতীয় পরিবেশ পদক অর্জন করেছেন। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অপর অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রজাপতি সংগ্রহ করে সেসব প্রজাপতির নামকরণ করেছেন, যা অনন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অনন্য কীর্তির মধ্যে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের নামও সংযুক্ত।

বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম নারী উপাচার্য। অধ্যাপক ড. রাশেদা আখতারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সরকার নারীর ক্ষমতায়নে আরও একটি মাত্রা যোগ করেছেন। রহিমা কানিজকে রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম নারীর ক্ষমতায়নের নতুন নজির স্থাপনে অংশীজন হয়েছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বমানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে। ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র নামে এ গবেষণা কেন্দ্রে এ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের গবেষণাগারে কীটপতঙ্গের জীনের বারকোডিং করা হচ্ছে, যা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মুক্তমঞ্চ’ বাংলাদেশ তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম, যা উপাচার্য অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সময়ে তৈরি করা হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের সাংস্কতিক রাজধানী বলা হয়। ১৯৮০ সালে সেলিম আল দীন রচিত ‘শকুন্তলা’ নাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক রাজধানীর তীর্থস্থান খ্যাত এই মুক্তমঞ্চের যাত্রা শুরু হয়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন নেত্রী প্রীতিলতার নামে হলের নামকরণ, ভাষা আন্দোলনের স্মারক ভাস্কর্য ‘অমর একুশ’ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ভাস্কর্য ‘সংশপ্তক’ ভাষা শহীদ সালাম বরকত ও রফিক জব্বারের নামে হলের নামকরণ, জাতির পিতার নামে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ নামে হলের নামকরণ।

ঘাতক দালাল নির্র্মূল আন্দোলনের পুরোধা নেত্রী জাহানারা ইমামের নামে ছাত্রী হলের নামকরণ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নামে ছাত্রী হলের নামকরণ, জাতির জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে ছাত্রী হলের নামকরণ, নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃত কবি সুফিয়া কামাল নামে হলের নামকরণ, বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাদানকারী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব নামে ছাত্রী হলের নামকরণের মধ্যদিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে।

বর্তমান সরকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ছাত্রদের ৩টি এবং ছাত্রীদের ৩টি আবাসিক হল প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনের অন্যান্য স্থাপনার কাজও শীঘ্রই শুরু হচ্ছে। সুতরাং এই প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন স্থাপনার কাজ সম্পন্ন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবয়ব যে আমুল বদলে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী (২২তম ব্যাচ), সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি।

কেএসকে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।