চার ধনকুবেরের কাছেই আফ্রিকার অর্ধেকের বেশি সম্পদ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আন্তর্জাতিক ডেস্ক আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:৪৩ পিএম, ২১ জুলাই ২০২৫
অক্সফামের তালিকায় আফ্রিকার শীর্ষ চার ধনী ব্যক্তি- (বাম দিক থেকে) নাইজেরিয়ান আলিকো ডাংগোট, দক্ষিণ আফ্রিকান জোহান রুপার্ট ও নিকি ওপেনহাইমার এবং মিশরের ধনকুবের নাসেফ সাওয়িরিস/ ছবি: দ্য ইস্ট আফ্রিকান

আফ্রিকার মাত্র চারজন শীর্ষ ধনকুবেরের মোট সম্পদের পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি ডলার, যা পুরো মহাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী, অর্থাৎ প্রায় ৭৫ কোটি মানুষের সম্মিলিত সম্পদের চেয়েও বেশি। এছাড়া আফ্রিকার শীর্ষ ৫ শতাংশ ধনীর হাতে রয়েছে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার পরিমাণ সম্পদ, যা বাকি জনসংখ্যার মোট সম্পদের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। এমন তথ্য উঠে এসেছে দারিদ্র্য বিমোচন ও বৈষম্যবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফামের প্রকাশিত একটি নতুন প্রতিবেদনে।

অক্সফামের প্রতিবেদনে আফ্রিকার শীর্ষ ধনী হিসেবে নাইজেরিয়ান বিলিয়নিয়ার আলিকো ডাংগোটের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তার সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ২৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। শীর্ষ চার ধনীর তালিকায় আরও রয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান রুপার্ট ও নিকি ওপেনহেইমার ও মিশরের ধনকুবের নাসেফ সাওয়িরিস।

অক্সফাম ইন আফ্রিকার পরিচালক ফাতি এনজি-হাসান বলেন, আফ্রিকার সম্পদ হারিয়ে যায়নি বরং একটি বিকৃত ব্যবস্থা সেটিকে শোষণ করছে, যেখানে ক্ষুদ্র একটি শ্রেণি বিপুল সম্পদ আহরণ করছে অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষ মৌলিক সেবাও পাচ্ছেন না।

দারিদ্র্য ও বৈষম্যের চরম রূপ

আফ্রিকা বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বৈষম্যপূর্ণ অঞ্চল। বিশ্বব্যাপী বৈষম্যের শীর্ষ ৫০টি দেশের মধ্যে ২৩টিই আফ্রিকান। চরম দারিদ্র্য পরিস্থিতিও এখানে নাজুক বর্তমানে বিশ্বে যারা চরম দারিদ্র্যে বাস করছেন, তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ আফ্রিকান। ১৯৯০ সালে এই হার ছিল মাত্র ১০ শতাংশ। মহাদেশটিতে ক্ষুধার মাত্রাও বেড়েছে ২০২২ সাল থেকে ২ কোটি মানুষ নতুন করে ক্ষুধার শিকার হয়ে মোট ৮৫ কোটি আফ্রিকান আজ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।

অক্সফাম বলছে, যদিও বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে, তবু আফ্রিকার সরকারগুলো বৈষম্য হ্রাসে সবচেয়ে কম প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষার মতো জনসেবার বাজেট কাটছাঁট করছে ও অত্যন্ত ধনী ব্যক্তিদের উপর বিশ্বের সর্বনিম্ন কর আরোপ করছে। পুরো মহাদেশে গড়ে সম্পদ কর বাবদ আদায় হচ্ছে জিডিপির মাত্র ০.৩%, যা এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও ওইসিডি দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। গত এক দশকে এই হার ২৫ শতাংশ কমেছে।

কর ব্যবস্থায় বৈষম্য আরও বাড়ছে

প্রতিটি ডলারের ব্যক্তিগত আয়কর ও সম্পদ কর সংগ্রহের বিপরীতে আফ্রিকান দেশগুলো প্রায় তিন ডলার সংগ্রহ করছে পরোক্ষ কর থেকে, যেমন ভ্যাট- যা দরিদ্র জনগণের উপর অধিক চাপ সৃষ্টি করে ও বৈষম্যকে আরও গভীর করে। ফলে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়েছে।

আফ্রিকার মোট জনসংখ্যার অর্ধেক ১৯টি দেশে বসবাস করছে, যেখানে গত এক দশকে আয় বৈষম্য অপরিবর্তিত বা আরও খারাপ হয়েছে। আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ জনগণের হাতে রয়েছে প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বাকি ৯৫ শতাংশ জনগণের মোট সম্পদের দ্বিগুণেরও বেশি।

সোমালিয়ার এল আফওয়েন শহরের এক ১০ সন্তানের মা ফাতুমা বলেন, আমাদের জন্য মাংস একটি বিলাসিতা। আমি দিনে মাত্র দুই ডলার রোজগার করি, অথচ এক কেজি ময়দার দাম তিন গুণ বেড়েছে।

প্রতিবেদনের অন্যান্য চাঞ্চল্যকর তথ্য

আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ জনগণ মাত্র তিনদিনে যত আয় করে, দরিদ্র অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে সেই আয় করতে এক বছর লেগে যায়।

আফ্রিকার পাঁচ ধনীতম ব্যক্তি যদি তাদের মোট সম্পদের ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ হারান, তবুও তারা মহাদেশের গড় মানুষের চেয়ে ৫৬ গুণ বেশি ধনী থাকবেন।

আফ্রিকায় পুরুষদের হাতে নারীদের তুলনায় তিনগুণ বেশি সম্পদ রয়েছে, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ লিঙ্গভিত্তিক সম্পদ বৈষম্য।

 

গত পাঁচ বছরে আফ্রিকান বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ৫৬ শতাংশ বেড়েছে।

ঋণচাপ ও জনসেবা সংকট

বর্ধমান ঋণের চাপে বহু আফ্রিকান দেশ দরিদ্র জনগণের উপর চাপ বাড়াচ্ছে, বাদ দিচ্ছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তার বাজেট অথচ ধনীদের উপর ন্যায্য কর আরোপ করছে না।

অক্সফাম ও ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স ইন্টারন্যাশনালের পূর্ববর্তী একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের ঋণপ্রাপ্ত ৪৭টি আফ্রিকান দেশের মধ্যে ৪৪টি দেশই ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জনসেবার বাজেট হ্রাস করেছে। এটি আফ্রিকান ইউনিয়নের ঘোষিত আগামী ১০ বছরে বৈষম্য ১৫ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যকে গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত করছে।

ফাতি এনজি-হাসানের ভাষ্য, সমাধান খুব জটিল নয় ধনীদের কাছ থেকে কর নিন, আর সাধারণ মানুষের ওপর বিনিয়োগ করুন। এর চেয়ে কম কিছু হলে তা হবে বিশ্বাসঘাতকতা। যদি আফ্রিকান নেতারা সত্যিই তাদের প্রতিশ্রুতিতে আন্তরিক হন, তাহলে ধনীদের পুরস্কৃত করা বন্ধ করে এমন অর্থনীতি তৈরি করতে হবে যা সবার জন্য কাজ করে।

বিকল্প উদাহরণ: ন্যায়বান অর্থনীতির সম্ভাবনা

তবে ইতিবাচক কিছু উদাহরণও রয়েছে। মরক্কো ও দক্ষিণ আফ্রিকা সম্পত্তি কর বাবদ যথাক্রমে জিডিপির ১ দশমিক শতাংশ ও ১ দশমিক শতাংশ সংগ্রহ করে, যা মহাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। সিশেলসে ২০০০ সাল থেকে সবচেয়ে দরিদ্র ৫০ শতাংশ জনগণের আয় ৭৬ শতাংশ বেড়েছে আর শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর সম্পদ কমেছে দুই-তৃতীয়াংশ। দেশটি সকল নাগরিককে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, মানসম্মত শিক্ষা ও শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়।

অক্সফামের হিসাব অনুযায়ী, আফ্রিকার ধনীদের উপর মাত্র ১ শতাংশ অতিরিক্ত সম্পদ কর ও ১০ শতাংশ অতিরিক্ত আয়কর আরোপ করলেই প্রতিবছর ৬ হাজার ৬০০ কোটি ডলার সংগ্রহ করা সম্ভব, যা দিয়ে মহাদেশজুড়ে বিনামূল্যে শিক্ষার ব্যয় এবং বিদ্যুৎবিহীন প্রতিটি পরিবার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ পৌঁছানো সম্ভব।

ফাতি এনজি-হাসানে বলেন, আফ্রিকার প্রতিটি নারী, পুরুষ ও শিশুর মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। কয়েকজন ধনকুবের যখন লজ্জাহীনভাবে সম্পদ জমান, আর লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের ফাঁদে বন্দী থাকেন, তখন পুরো ব্যবস্থাই শুধু ভেঙে পড়ে না, তা হয়ে যায় নৈতিক দেউলিয়াত্ব। আফ্রিকান ইউনিয়নের নেতারা যদি সত্যিই আফ্রিকার ভবিষ্যৎ গঠনে আগ্রহী হন, তাহলে দেরির আর সুযোগ নেই। ধনীদের কর দেওয়ানো কেবল ন্যায়সঙ্গত নয়, আবশ্যিক।

সূত্র: দ্য ইস্ট আফ্রিকা

এসএএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।