দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন
রাশিয়ার ভয়ে অস্ত্রের পেছনে ছুটছে ইউরোপ, অনিশ্চিত মার্কিন সমর্থন
রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের ভয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত অবস্থানের শঙ্কায় মারাত্মক প্রতিরক্ষা সংকটে পড়েছে ইউরোপের দেশগুলো। পরিস্থিতির গুরুত্ব এখন আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করছে তারা। এরই অংশ হিসেবে ইউরোপজুড়ে শুরু হয়েছে অভূতপূর্ব অস্ত্র কেনার প্রতিযোগিতা।
ইইউর ১৫০ বিলিয়নের তহবিল, পোল্যান্ড একাই চায় ৪৩
চলতি বছরের মে মাসে ইউরোপীয় কমিশন চালু করেছে ১৫০ বিলিয়ন ইউরোর ‘সিকিউরিটি অ্যাকশন ফর ইউরোপ’ (এসএএফই বা সেফ) তহবিল। এটি ইইউ সদস্যদের কম সুদে প্রতিরক্ষা বিনিয়োগের জন্য ঋণ দেয়। সদস্য দেশগুলোর সামরিক সক্ষমতার ঘাটতি পূরণ এবং যৌথ সামরিক ক্রয়ের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা শিল্পকে শক্তিশালী করা এই তহবিলের লক্ষ্য।
সমালোচকরা শুরুতে সন্দেহ করেছিলেন, এতে আগ্রহী দেশ পাওয়া যাবে কি না। কিন্তু ৩০ নভেম্বর সময়সীমা শেষে দেখা গেলো, ২৭ সদস্যের মধ্যে ১৯ দেশই ঋণের জন্য আবেদন করেছে এবং পুরো তহবিল পূর্ণ হয়ে গেছে। পোল্যান্ড একাই আবেদন করেছে ৪৩ দশমিক ৭ বিলিয়ন ইউরোর জন্য।
আরও পড়ুন>>
পোল্যান্ডে রুশ ড্রোন ভূপাতিত করলো ন্যাটো
রাশিয়া আতঙ্কে পোল্যান্ডের আকাশসীমা বন্ধ, বাল্টিক সাগরে বাড়লো ন্যাটোর উপস্থিতি
এবার রোমানিয়ায় ঢুকলো রাশিয়ার ড্রোন, ন্যাটো যুদ্ধবিমানের ধাওয়া
‘রেডিনেস ২০৩০’ পরিকল্পনা
সেফ ছাড়াও ইইউর প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানোর আরেকটি হাতিয়ার হলো ‘ন্যাশনাল এসকেপ ক্লজ’ (এনইসি)। এটি সদস্য দেশগুলোকে সামনের চার বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের ১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত অতিরিক্ত সামরিক ব্যয়ের সুযোগ দেয়, ঘাটতি-নিষেধাজ্ঞা না ভেঙেই। জার্মানিসহ এখন পর্যন্ত ১৬টি দেশ এতে যুক্ত হয়েছে। এই ধারাটি সক্রিয় হলে ইউরোপে আরও ৬৫০ বিলিয়ন ইউরো সামরিক খাতে ব্যয় বাড়তে পারে।
এদিকে, গত জুনে ন্যাটো বৈঠকে ইউরোপীয় সদস্যরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে সামরিক বাজেট জিডিপির দুই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশে নেওয়ার, পাশাপাশি প্রতিরক্ষা অবকাঠামোতে আরও ১ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় করার।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তন এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় উদ্বেগ। দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা পেন্টাগনের ‘গ্লোবাল পোসচার রিভিউ’ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরে সামরিক সক্ষমতা স্থানান্তর ও ইউরোপ থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এখন ইউক্রেনকে দেওয়া অস্ত্রের খরচ ইউরোপকে বহন করতে বলেছে। আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিকল্পিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ইউরোপের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা বাড়ছে।
২০২৭ সালের মধ্যেই সংঘাতের ঝুঁকি
লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ (আইআইএসএস) সতর্ক করেছে, রাশিয়া যুদ্ধ-অর্থনীতি গড়ে তোলায় ২০২৭ সালের মধ্যেই ইউরোপের জন্য প্রত্যক্ষ হুমকি তৈরি হতে পারে। সংস্থার মহাপরিচালক বাস্টিয়ান গিগেরিখ জানান, ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যয় এবার পুরো ইউরোপীয় ন্যাটো সদস্যদের সমান হয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, ইউক্রেনের প্রতিরোধ ইউরোপকে প্রস্তুতির জন্য একটি সুযোগ দিয়েছে। যুদ্ধ শেষ হলে সেই সুযোগ দ্রুত হারিয়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্র-নির্ভরতা কাটাতে লাগবে ট্রিলিয়ন ডলার
আকাশ-ভিত্তিক গোয়েন্দা সক্ষমতা, কৌশলগত পরিবহন, দূরপাল্লার নির্ভুল হামলা, হাইপারস্কেল ক্লাউড কম্পিউটিংসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ক্ষেত্রে ইউরোপ দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। আইআইএসএসের হিসাব বলছে, এসব সক্ষমতা ইউরোপকে একা অর্জন করতে হলে খরচ হবে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার।
সাবেক ন্যাটো কর্মকর্তা কামিল গ্রাঁ-র মতে, এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো ইউক্রেনকে আরও শক্তিশালী সহায়তা দেওয়া, বিশেষ করে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা এবং আকাশ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম। দ্বিতীয়ত, ইউরোপের নিজেদের সামরিক সক্ষমতা পুনর্গঠন, যার জন্য মহাদেশব্যাপী সমন্বিত আকাশ প্রতিরক্ষা দরকার, যা ড্রোন থেকে শুরু করে হাইপারসনিক মিসাইল পর্যন্ত প্রতিহত করতে সক্ষম।
তৃতীয় কাজ হবে, মার্কিন সক্ষমতার বিকল্প গড়ে তোলা। গ্রাঁ মনে করেন, ইউরোপ পরবর্তী দশকের মধ্যে এর সবই করতে পারবে।
দক্ষতা ও সক্ষমতার ঘাটতিই বড় বাধা
ইউরোপের ধীরগতির সামরিক ক্রয়প্রক্রিয়া ও দুর্বল শিল্পভিত্তি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২২ সাল থেকে ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা চুক্তির ৫৩ শতাংশ গেছে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে, বাকি ৩৬ শতাংশ প্রধানত খরচ হয়েছে মার্কিন এফ–৩৫ যুদ্ধবিমান কেনায়।
কিন্তু আজকে যদি চুক্তি হয়, তবুও অস্ত্র সরবরাহে লাগবে দুই থেকে তিন বছর। সাত দেশের যৌথ প্রকল্প এলসা (ইএলএসএ) দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির উদ্যোগ নিলেও ১৮ মাস পরও এখনো ঠিক করেনি কোন মডেল তৈরি হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিল্পকে ‘কারিগরি উৎপাদন’ থেকে ‘শিল্প-স্কেলের’ উৎপাদনে যেতে হবে এবং প্রতিটি দেশের উচিত দ্রুত অর্ডার দেওয়া, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা, এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তি গ্রহণে ঝুঁকি নেওয়া।
কেএএ/