বিদ্রোহী নজরুল: জীবনসংগ্রাম থেকে অনন্ত নীরবতা

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:০৬ পিএম, ২৮ আগস্ট ২০২৫

কামরুল হাসান হৃদয়

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহ, প্রেম, সাম্য ও মানবতার কবি। জন্ম থেকে মৃত্যু—প্রতিটি অধ্যায়ই ছিল সংগ্রাম, আলোড়ন ও বিস্ময়ের। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নজরুল এমন এক নাম, যিনি কলম হাতে যেমন শাসকের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন; তেমনই প্রেম, মানবতা আর ধর্মীয় সম্প্রীতির বাণী ছড়িয়েছেন গান ও কবিতায়।

১৮৯৯ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নজরুলের। শৈশবে বাবাকে হারানো এই শিশু জীবনের প্রথম থেকেই অভাবের কষ্ট চিনে ফেলেছিল। কখনো লেটো গানের দলে গান গাওয়া, কখনো মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ—অভাবই ছিল তাঁর জীবনের শিক্ষক। তাই হয়তো পরে তিনি লিখেছিলেন শৈশবের সেই দারিদ্র্যের সখ্যের কথা কুকুর, বিড়াল, কাকের সঙ্গে খেলে বেড়ানোর স্মৃতি।

কৈশোরে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন নজরুল। যুদ্ধের বুট জুতা পায়ে থাকলেও ভেতরে ছিলেন কবি। সেনা শিবিরেই লিখতে শুরু করেন কবিতা, গল্প, গান। নিজেকে আখ্যা দেন দুর্জয় সৈনিক হিসেবে। যুদ্ধক্ষেত্রে যে বজ্রকণ্ঠে মহাগর্জন তোলেন।

১৯২২ সালে প্রকাশিত ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থ তাঁকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দেয়। বিদ্রোহী কবিতা তাঁকে করে তোলে প্রজন্মের মুখপাত্র। যেখানে তিনি ঘোষণা দেন, তিনি চির বিদ্রোহী বীর, যিনি বিশ্ব ছাড়িয়ে উঠিয়েছেন চির-উন্নত শির। তাঁর কলম যেমন শাসকবিরোধী; তেমনই মানবতার পক্ষে প্রেমময়ও।

ধূমকেতু পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি সরব হয়ে ওঠেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। এজন্য তাঁকে বারবার কারাবন্দি হতে হয়। জেলখানার লৌহকপাট ভেঙে ফেলার আহ্বান জানান কবিতায়, রক্ত-জমাট শিকলকে সমাপ্তির দিকে ঠেলে দেন কবির বজ্রনাদে।

১৯২৪ সালে প্রমীলা দেবীকে বিবাহ করেন নজরুল। সামাজিকভাবে এই বিয়ে আলোড়ন তোলে। সংসারে সুখের চাইতে দুঃখই ছিল বেশি। কয়েক সন্তানের অকালমৃত্যু তাঁকে শোকে ভেঙে দেয়। তাই হয়তো তিনি লিখেছিলেন—সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে, কিন্তু পিতার নামে যেন ঘৃণা না থাকে।

নজরুলের জীবনভর সঙ্গী ছিল দারিদ্র্য ও অনটন। অসীম প্রতিভার অধিকারী হয়েও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর নিজের ভাষায় জীবনের এই দুঃখ-দুর্দশা, অভাবের কষ্টই হয়ে উঠেছিল তাঁর কবিতার উৎস। ১৯৪২ সাল থেকে বিরল স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে বাগ্‌রুদ্ধ হয়ে পড়েন নজরুল। বজ্রকণ্ঠে যিনি গর্জে উঠতেন, তিনিই তখন নীরবতার বন্দি। কণ্ঠ শুকিয়ে গেলেও তাঁর অন্তরে যেন বাজত অনন্ত বিজয়গান।

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে দাফন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে। মৃত্যুর আগেই তিনি কবিতায় জানিয়ে গিয়েছিলেন মৃত্যু আসবেই, তবে ভয় নেই; জীবন তিনি করবেন দান, অমর হয়ে থাকবেন নামেই।

জাতীয় কবি নজরুল ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার প্রতীক কবি, সৈনিক, বিপ্লবী, প্রেমিক এবং মানবতার দূত। তাঁর বিদ্রোহ অন্যায়ের বিরুদ্ধে, তাঁর প্রেম মানবতার জন্য। আজ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে সেই আহ্বান—অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত, সাম্যের সমাজ গড়ার প্রতিজ্ঞা।

লেখক: কথাশিল্পী ও সংবাদকর্মী।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।