চলে গেলেন গানের মানুষ রবিন ঘোষ
দীর্ঘদিন অসুখের সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে চলেই গেলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংগীত পরিচালক ও চলচ্চিত্রাভিনেত্রী শবনমের স্বামী রবিন ঘোষ। রাজধানীর গুলশানের কিউর মেডিক্যাল সেন্টারে আজ শনিবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
রবিন ঘোষের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেছে তার পরিবার। মৃত্যুকালে রবিন ঘোষের বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
অভিনেত্রী শবনম জানালেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে ব্রঙ্কাইটিস ও হৃদরোগে ভুগছিলেন রবিন ঘোষ। হঠাৎ শরীর বেশি খারাপ হলে তাকে বুধবারে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার শেষ যাত্রা হলো।’
তিনি আরো জানিয়েছেন আজ শনিবার বিকেলেই রাজধানীর ওয়ারিতে রবিন ঘোষের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।’
প্রসঙ্গত, রেডক্রসে কর্মরত পিতার চাকরির সূত্রে রবিন ঘোষের জন্ম হয় বাগদাদে ১৯৩৯ সালে। ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ইরাকের বাগদাদে স্থানান্তরিত হন। সেখানেই রবিন ঘোষ খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের একটি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তার এক ভাই অশোক ঘোষ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে বিখ্যাত পরিচালক ছিলেন।
২য় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি পরিবারের সাথে ঢাকায় ফিরে আসেন। মিউজিকের প্রতি আগ্রহ একদম অল্প বয়স থেকেই তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। গ্র্যাজুয়েশন করার পর সেই সময় তিনি রেডিওতে কাজ শুরু করেন।
চলচ্চিত্রের সোনালী অধ্যায়ের ষাটের দশকে পরিচালক এহতেশামের ‘রাজধানীর বুকে’ চলচ্চিত্রের গানের মাধ্যমে সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে রবিন ঘোষের অভিষেক ঘটে। এরপর থেকে তিনি অগণিত বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রের গানে সুরারোপ করেছেন এবং সংগীত পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে তালাস, পয়সা এবং ভাইয়া অন্যতম।
‘রাজধানীর বুকে’ ছবিতে রবিন ঘোষ ফেরদৌসী রহমানের সাথে যৌথভাবে সংগীত পরিচালনা করেন। ছবির ‘তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো’ গানটি তালাত মাহমুদের কণ্ঠে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরে বাংলা ছবি ‘হারানো দিন’, ‘পীচঢালা পথ’, ‘নতুন সুর’, ‘নাচের পুতুল’ ইত্যাদি ছবিতে সুরারোপ করেন। ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা’, আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে ‘পীচঢালা এই পথটারে’, শাহনাজ রহমতউল্লাহর কণ্ঠে ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’, মাহমুদুন্নবীর কণ্ঠে ‘আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন’ গানগুলি সেই সময় প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়।
‘তুম মেরে হো’ চলচ্চিত্রটি মুক্তিলাভের পর রবিন ঘোষ করাচিতে চলে যান। সেখানে তিনি চলচ্চিত্রের গানে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত একাধারে সুর করেন। তিনি আয়না চলচ্চিত্রের গানগুলোয় সুরারোপ করেন। এ চলচ্চিত্রটি পরবর্তীতে পাকিস্তানের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম সফল চলচ্চিত্রের মর্যাদা পায়।
রবিন ঘোষ তালাশ (১৯৬৩), চকোরী (১৯৬৭), চাহাত (১৯৭৪), আয়না (১৯৭৭), আম্বার (১৯৭৮) এবং দরিয়ান (১৯৮৪) চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে নিগার পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৫০-এর দশকে রবিন ঘোষ এক বন্ধুর মাধ্যমে ঢাকা রেডিও স্টেশনে চাকরির জন্য প্রস্তাব পান। ওই বন্ধুর বোন ঝর্না বসাক তখন বাংলা চলচ্চিত্রে মাঝে-মধ্যে অভিনয় করতেন। এ ঝর্না বসাকই পরবর্তীকালে বিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শবনম হিসেবে পরিচিত পান। দুই পরিবারের সম্মতিতে ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর তাদের বিবাহকার্য সম্পন্ন হয়। ১৯৬৬ সালে এ দম্পতির রনি নামে এক সন্তান জন্মগ্রহণ করে। বর্তমানে তাঁরা বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
গানের ভুবনের এই নিভৃতচারী গুণী মানুষটির প্রয়াণে শোকের ছায়া নেমেছে সংগীতাঙ্গনে। জাগো নিউজ পরিবারও রবিন ঘোষের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছে। সেইসঙ্গে তার বিদেহি আত্মার শান্তি কামনা করছে।
এলএ